Home First Lead বুদ্ধিজীবী হত্যা : উদ্দেশ্য বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করা

বুদ্ধিজীবী হত্যা : উদ্দেশ্য বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করা

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক

স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে শুরু থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেছিল, যুদ্ধের শেষ দিকে এসে পরাজয়ের আগমুহূর্তে তা রূপ নেয় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ডে। এ হত্যাযজ্ঞের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা লাভ করতে যাওয়া বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে ফেলা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না, তখন তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করে।

২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনায় একসঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয় যা বিশদ আকারে রূপ নেয় ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাকান্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়।

ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেকশ ডিসেম্বরের ৮ তারিখে ভারতীয় রেডিও থেকে পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। বলেন যৌথবাহিনী চারদিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলেছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ১০ ডিসেম্বরের পর মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। এমন এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানিরা বিদেশি সাহায্যের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু সাহায্য না পেয়ে নিশ্চিত পরাজয় জেনে শেষ কামড় হিসেবে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যার’ নীলনকশা চূড়ান্ত করে তারা।

১০ ডিসেম্বর থেকেই এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় বেছে বেছে হত্যা করেছিল জাতির অগ্রণী শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের। তবে বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা করা হয় ১২ ডিসেম্বর। ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে সেনানিবাসে প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সভাপতিত্বে বৈঠক থেকেই আলবদর, আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট দোসর জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

সেদিন রাতে প্রাদেশিক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আলবদর ও আলশামসের কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের ডেকে পাঠান সদর দপ্তরে। তার সভাপতিত্বে গোপন শলাপরামর্শ অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। তাদের হাতে ফরমান আলী তুলে দেন বুদ্ধিজীবীসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা। তালিকা অনুযায়ী পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মে এ তিনটি ঘাতক গ্রুপ মেতে ওঠে।

পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পক্ষে এ হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকান্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনী।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে গঠতি হওয়া আল বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মতিউর রহমান নিজামী। এই ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়েই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী মিলিশিয়া হিসেবে গঠিত হয়েছিল আলবদর বাহিনী। ঢাকা নগর ছাত্রসংঘের আমির আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও এসব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল কাদের মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের আঙ্গুল কাটার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা তাদের সম্পর্কে খবর দেয়া, তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাওয়া ও তাদের হত্যার কাজটি করেছিল আলবদর।

কারফিউর মধ্যে ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর সারা দেশে একযোগে সর্বাধিক সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। ওইদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানি, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা এই সুপরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের শিকার হন। হত্যাকারীরা চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তাদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে গেস্টাপো কায়দায় তুলে নিয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে কোন বিশেষ নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। এসব নির্যাতন কেন্দ্র ছিল মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (মোহাম্মদপুর) এবং শহরের অন্যান্য এলাকায়।

তাদের ওপর চলে নির্মম দৈহিক নির্যাতন। তারপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেয়নেটের আঘাতে তাদের দেহ ক্ষতিবিক্ষত করে হত্যা করা হয়। ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান বধ্যভূমি ছিল আলেকদি, কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুর বাংলা কলেজের পশ্চাৎভাগ, হরিরামপুর গোরস্তান, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি, মোহাম্মদপুর থানার পূর্বপ্রান্ত ও রায়ের বাজার। রায়ের বাজার ও মিরপুরের জলাভূমিতে ডোবানালা, নিচু জমি ও ইটের পাঁজার মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বহুসংখ্যক মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা এবং পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত এই লাশগুলোর অধিকাংশেরই দেহ ফুলে উঠেছিল। তাদের বুকে মাথায় ও পিঠে ছিল বুলেটের আঘাত এবং সারাদেহে বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন।

১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিকটআত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের গলিত ও ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে পান। বুদ্ধিজীবীদের লাশে ছিল আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা ছিল বাঁধা। কারো কারো শরীরে ছিল একাধিক গুলি। অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি।

বুদ্ধিজীবী নিধন প্রক্রিয়ায় যারা চিরকালের জন্য নিখোঁজ হয়েছেন এবং বধ্যভূমিতে যাদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. জেসি দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ডা. ফজলে রাব্বী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ডা. আলিম চৌধুরী, সাংবাদিক-সাহিত্যিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, ড. গোলাম মোর্তজা, ড. মোহাম্মদ শফি, সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ, লাডু ভাই, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, আলতাফ মাহমুদ, রশীদুল হাসান, আবুল বাশার, ড. মুক্তাদির, সায়ীদুল হাসান, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেকে।

সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিচয় দূরের কথা, তাদের প্রকৃত সংখ্যাই অদ্যাবধি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। প্রাপ্ত তথ্যসূত্র থেকে শহীদদের মোটামুটি একটা সংখ্যা দাঁড় করানো যায়। এদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, পাঁচজন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য দুইজন।

বুদ্ধিজীবীদরে হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন (অপারেশন ইনচার্জ) ও আশরাফুজ্জামান খান (প্রধান জল্লাদ)। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের দেয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী রায়েরবাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি হতে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ পাওয়া যায় যাদের সে নিজ হাতে গুলি করে মেরেছিল।

চৌধুরী মঈনুদ্দীন ৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। সে অবজারভার ভবন হতে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিত। এ ছাড়া আরও ছিল এবিএম খালেক মজুমদার (শহীদুল্লা কায়সারের হত্যাকারী), মাওলানা আবদুল মান্নান (ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যাকারী), আবদুল কাদের মোল্লা (কবি মেহেরুন্নেসার হত্যাকারী) প্রমুখ। চট্টগ্রামে প্রধান হত্যাকারী ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার দুই ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং গিয়াস কাদের চৌধুরী।

বহু প্রতীক্ষার পর ২০১৬ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, ২০১৫ সালে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও ২০১৩ সালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান পলাতক থাকায় তাদের বিচার এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তাদের ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড নামে পরিচিত, যা আমাদের জাতীয় জীবনে নজিরবিহীন নৃশংসতা এবং এক ভয়ঙ্কর নীলনকশা বাস্তবায়নের একটি প্রামাণ্য দলিল। ১৪ ডিসেম্বরের সেই নিষ্ঠুরতার পেছনে মতাদর্শের ভূমিকা ও স্বরূপ যে এখনো আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পেরেছি, তা বলা যাবে না। পরতে পরতে উন্মোচিত হয়েছে এই হত্যাকান্ডের বাস্তবতা এবং সেই উন্মোচন এখনো এত বছর পরও রয়েছে অব্যাহত।