Home খেলাধুলা জলের রাজা ব্রজেন দাস

জলের রাজা ব্রজেন দাস

পঞ্চাশের দশকে প্রথম দক্ষিণ এশীয় সাঁতারু হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পার করে ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেছিলেন ব্রজেন দাস (Brajen Das)। শুধু একবার নয় ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে মোট ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে অতিক্রম করেছিলেন তিনি। মিশরীয় বিখ্যাত সাঁতারু আবদুল এল রহিমের রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছিলেন ব্রজেন দাস। এছাড়াও ১৯৫২ সালে ঢাকার জাতীয় অলিম্পিকে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রথম হন তিনি। ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে আয়োজিত এক বিরাট সাঁতার প্রতিযোগিতায় ২৬ মাইল দূরত্ব ১৫ ঘন্টা ২৮ মিনিটে সাঁতার কেটে অতিক্রম করার খেতাব রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘প্রাইড অফ পারফর্ম্যান্স’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ‘জাতীয় পুরস্কার’ পান।

১৯২৭ সালের ৯ ডিসেম্বর (মতান্তরে ৭ ডিসেম্বর) বিক্রমপুরের  কুচিয়ামোড়া গ্রামে ব্রজেন দাসের জন্ম হয়।

গ্রামেরই এক পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয়েছিল তাঁর। এরপরে ঢাকার কে.এল.জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন ব্রজেন দাস। ১৯৪৬ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আই.এ এবং বি.এ পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। ব্রজেন শৈশব থেকেই সাঁতারে পারদর্শী ছিলেন। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ধলেশ্বরী নদীতে সাঁতারের হাতেখড়ি ঘটেছিল তাঁর। ধলেশ্বরী থেকে কখনো সাঁতার কেটে বুড়িগঙ্গায় চলে যেতেন তিনি। ১৯৪৪ সালে তাঁর গ্রামের বাড়ির এক বিশাল পুকুরে অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত সাঁতারু প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে এক প্রদর্শনী সাঁতারে অংশ নিয়েছিলেন তিনি এবং সেই সময় থেকেই তাঁর মনে এক দক্ষ সাঁতারু হয়ে ওঠার দামাল স্বপ্নের জন্ম হয়। ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে তিনি প্রথম হন।

কলেজ জীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন ব্রজেন দাস। প্রফুল্ল ঘোষ ছাড়াও তিনি তখন বিখ্যাত সাঁতারু শ্যামাপদ গোস্বামী, মহাম্মদ আলী প্রমুখের কাছে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, আধুনিক সাঁতারের কলাকৌশল শিখেছেন তাঁদের কাছেই। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানে সেভাবে সাঁতার প্রশিক্ষণের কোনোরূপ ব্যবস্থাই ছিল না, তাঁরই অনুরোধে পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশন ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে একটি সাঁতার প্রতিযোগিতা শুরু করে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০, ২০০, ৪০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল শ্রেণিতে পরপর ৪ বছরই চ্যাম্পিয়ন হন ব্রজেন দাস। এরই মাঝে ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল প্রতিযোগিতায় বিজেতার শিরোপা জেতেন তিনি। ১৯৫৬ সালের ঢাকা স্টেডিয়ামে চ্যানেল কোর্স করার প্রস্তুতি হিসেবে একনাগাড়ে প্রথমে ১২ মাইল, পরে ২৪ মাইল এবং শেষে টানা ৪৮ ঘন্টা সাঁতার কেটেছিলেন ব্রজেন দাস। ১৯৫৭ সালের ১৬ আগস্ট বাংলাদেশে আয়োজিত এক বিরাট সাঁতার প্রতিযোগিতায় ২৬ মাইল দূরত্ব তিনি ১৫ ঘন্টা ২৮ মিনিটে সাঁতার কেটে অতিক্রম করেন। ঠিক এর পরের বছর ১৯৫৮ সালের ২৭ মার্চ ইংলিশ পেরোনোর লক্ষ্যকে বুকে নিয়ে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী, পদ্মা ও মেঘনা হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত দীর্ঘ ৮৫ মাইল সাঁতার কাটেন ব্রজেন দাস। এই ঘটনা বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশের সাঁতারুদের কাছে আজও বিস্ময়কর। ইতিমধ্যে ১৯৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আয়োজিত অলিম্পিকে অভাবিতভাবে তাঁকে স্থান না দেওয়ায় এক অদম্য জেদ চেপে বসে ব্রজেনের মনে। ১৯৫৮ সালে বিলি বাটলিন্স চ্যানেল ক্রসিং সাঁতার প্রতিযোগিতার এক বিজ্ঞাপন দেখে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫৮ সালের ১৯ মে ইংল্যাণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ব্রজেন দাস। ইংলিশ চ্যানেলে সরাসরি সাঁতারে নামার আগে ভূমধ্যসাগরে নেপলস থেকে ক্রাপি আইল্যাণ্ড পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ দূরত্ব সাঁতার কেটে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি। বলা যায় ইংলিশ চ্যানেল পেরোনোর আগে এটি ছিল একটি নির্বাচনী প্রতিযোগিতা। ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট রাত্রে মোট ২৩টি দেশের ৩৯ জন সাঁতারুকে নিয়ে শুরু হয় ২১ মাইল দীর্ঘ কনকনে ঠাণ্ডা জলের ইংলিশ চ্যানেলের সাঁতার প্রতিযোগিতা। একে গভীর অন্ধকার, তার উপরে কুয়াশা ঢাকা পরিবেশে প্রবল শীতে ঠাণ্ডা জল যেন ব্রজেনের চামড়া ভেদ করে ভিতরেও কাঁপুনি ধরিয়েছিল। জোয়ার-ভাটা মিলিয়ে মোট ৩৫ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় তাঁকে। মধ্যরাত্রে ফ্রান্সের উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত মোট ১৪ ঘন্টা ৫২ মিনিটে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে রেকর্ড তৈরি করেন ব্রজেন দাস। তিনিই ছিলেন ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমকারী প্রথম দক্ষিণ এশীয় সাঁতারু। পরবর্তীকালে ব্রজেন দাস এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দোভার বন্দরের কাছে এসে সামুদ্রিক স্রোতের প্রাবল্যের কারণে তীরে পৌঁছাতেই মাত্র তিন মাইলের পথ পেরোতে প্রায় তিন ঘন্টা ধরে উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে তাঁকে সাঁতার কেটে যেতে হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার তাঁর এই ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো অর্থনৈতিক সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও চ্যানেল জয় করে ফিরে এলে ব্রজেন দাসকে ‘বঙ্গাল কা সের’ উপাধি দেয় পাকিস্তান সরকার। শুধু একবার নয়, ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে মোট ছয়বার তিনি ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মোট ১০ ঘন্টা ৩৫ মিনিটে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন ব্রজেন দাস। এই বছরই তাঁকে নিয়ে ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় লেখা হয় ব্রজেন দাসের সাঁতার কাটার মধ্যে বিশেষ একটা রীতি আছে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল সবথেকে কম সময়ের বিশ্বরেকর্ড। ২০০৭ সালে পিটার স্টয়চভ মাত্র ৬ ঘন্টা ৫৭ মিনিটে এই ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে এই রেকর্ড ভাঙেন। ২০১২ সালে আবার ট্রেন্ট গ্রিমস মাত্র ৬ ঘন্টা ৫৫ মিনিট সময়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে এই রেকর্ড ভেঙে দেন।

১৯৬১ সালে ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল পেরোবার সুবাদে ইংল্যাণ্ডের রানি ভিক্টোরিয়া তাঁকে বিশেষ পুরস্কার প্রদান করে ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে ইংলিশ চ্যানেলকে তিনি নাকি নিজের বাথটবে পরিণত করেছেন! ১৯৬৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন সুইমিং হল অফ ফেমে একজন সম্মানীয় সাঁতারুর খেতাব জিতে নেন ব্রজেন দাস। পরবর্তীকালে ১৯৮৬ সালে চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন অফ দ্য ইউনাইটেড কিংডম তাঁকে ‘কিং অফ চ্যানেল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘প্রাইড অফ পারফর্ম্যান্স’ পুরস্কারে ভূষিত করে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের থেকে ১৯৭৬ সালে জাতীয় পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন ব্রজেন দাস।

১৯৬৪ সালে আমেরিকার আটলান্টা সিটিতে ওয়ার্ল্ড লং ডিস্টেন্স সুইমিং ফেডারেশনের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন ব্রজেন দাস।