দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো মাঝারি মানের। জটিল অসুখ করলে মানুষজন সিঙ্গাপুরে যায়। তবে পরিচ্ছন্নতা ও জনস্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়ে সরকারের কড়া নজর। জানুয়ারির শেষের দিকে প্রায় তেরশো কিলোমিটার দূরে চিনের উহানে যখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে, ভিয়েতনামে তখন আক্রান্তের সংখ্যা দুই। জুন মাসে এসে গোটা বিশ্বে করোনা সংক্রামিত যখন ৬০ লক্ষের বেশি, ভিয়েতনামে তখন আক্রান্ত ৩২৮ জন। আবার সেরেও উঠেছেন ২৭৯ জন। সংক্রমণে মৃত্যু একটিও নেই।
জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি চিনে যখন করোনা মহামারীর পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে তখন থেকেই আঁটঘাট বেধে ফেলেছিল ভিয়েতনাম। ২৩ জানুয়ারি ২ জনের শরীরে ভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ে। চিনের এক বাসিন্দা যিনি কর্মসূত্রে ভিয়েতনামে থাকতেন এবং তাঁর বাবা। চিন ঘুরে আসার পরেই সংক্রামিত হন দু’জনে। সেই শুরু। স্বাস্থ্যমন্ত্রক ততদিনে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। ২৭ জানুয়ারি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠকে ঠিক হয়, দেশের দরজা ভিনদেশীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। তার তিন দিন পরেই, দেশের প্রতিটি ঘরে গিয়ে স্ক্রিনিং ও সন্দেহভাজনদের খুঁজে বার করার বৃহত্তর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তৈরি হয় জাতীয় কমিটি। ওই দিনই করোনাভাইরাসকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সঙ্কট বলে ঘোষণা করেছিল হু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন সামনে আসার আগেই দেশবাসীর জন্য করোনা ঠেকানোর স্বাস্থ্যবিধি প্রকাশ করেছিল ভিয়েতনাম।
চিন বা দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় অনেক দরিদ্র দেশ। প্রধানত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের বাস এই দেশে। স্বাস্থ্য পরিষেবাও বিশ্বের অন্য দেশগুলোর নিরিখে বেশ সাধারণ মানের। অথচ গত কয়েকমাসে বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণের যে নিদর্শন দেখাল ভিয়েতনাম, বিশ্বের কাছে সেটা সত্যিই শিক্ষণীয় ব্যাপার। সীমিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর ভিত্তি করেই শুধুমাত্র কঠোর নিয়ম, সরকারি নির্দেশিকা ও জনগণের সচেতনতা ও সংহতিকে সম্বল করেই করোনাভাইরাসকে হারিয়ে দিল ভিয়েতনাম। ১০ কোটি জনসংখ্যার দেশে এখনও অবধি সংক্রমণে একজনেরও মৃত্যু হয়নি। আক্রান্তদের বেশিরভাগই সেরে ওঠার পথে। সঙ্কটাপন্ন রোগীর সংখ্যা হাতে গোনা, তবে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে, তাঁরাও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
“আমাদের দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল খুব কড়া ব্যবস্থা নেয়। দেশের সাতশোরও বেশি জেলায় ১১ হাজার হেলথ সেন্টার, কোভাড কোয়ারেন্টাইন সেন্টার এবং অসংখ্য আইসেলোশন ওয়ার্ড তৈরি হয়,” বলেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড এপিডেমোলজির ডেপুটি প্রধান ফাম কোয়াং থাই। তিনি বলেছেন, দেশের কোন কোন জেলায় আগে স্ক্রিনিং শুরু হবে, কী ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হবে তার প্রোটোকল তৈরি করে সেই মতো কাজ শুরু হয়ে যায় ১৪ দিনের মধ্যেই। হ্যানয়ে শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল বাচ মাই-এলাকায় সংক্রামিত রোগী বেশি ধরা পড়ায় ওই এলাকাকে হটস্পট চিহ্নিত করে প্রতিজনের স্ক্রিনিং করা হয়। হাসপাতাল চত্বরের ১৫ হাজার মানুষ ও হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীকে পরীক্ষা করে সংক্রমণ সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। একদিকে স্বাস্থ্যকর্মীদের কোভিড পরীক্ষা শুরু হয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে সংক্রামিতদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়। গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে মেডিক্যাল টিম।যে সব মানুষ করোনা আক্রমণে কোয়ারেন্টাইনে গৃহবন্দী, তাদের কাছে নিয়মিত ভাবে খাবার, ওষুধ, জল এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি লকডাউন শিথিল হলেও, রাস্তায় বাধ্যতামূলক মাস্ক, পারস্পরিক দূরত্ববিধি এবং রাস্তাঘাটে, দোকানে-বাজারে দেহের তাপমান পরীক্ষা করার কাজ এখনও চলছে। কোভিড স্ক্রিনিং হয়নি এমন একজনও নেই দেশে। প্রতি এলাকার প্রতিটি বাড়ি ঘুরে পর্যবেক্ষণের কাজও চলছে। বড় শহরগুলির অনুকরণে ছোট শহরগুলিও একই ভাবে নিজেদের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখছে।