মীর আব্দুল আলীম
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ২৬ নভেম্বর ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এভাবে প্রায়ই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে দেশ, যা দেশবাসীর মনে আতঙ্ক ছড়ায়। সবার ভয়, এই বুঝি ভেঙে পড়বে ঘর-বাড়ি মাথার ওপর; এই বুঝি মৃত্যু নিশ্চিত। ভূমিকম্পকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে।
দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। প্রশ্ন হলো ভূমিকম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? রানা প্লাজা ধসের পরই আমাদের সক্ষমতা কতটুকু তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। ভূমিকম্প পরবর্তী প্রস্তুতি খুবই জরুরি। হাল সময়ে যে ভূমিকম্প হচ্ছে, প্রায় সব কটারই উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা, মায়ানমার, নেপাল কিংবা চীন। আমাদের সবচেয়ে কাছে ত্রিপুরায় উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৫, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে ৭.৪ এবং ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়েছে। আমাদের থেকে ভৌগোলিকভাবে সে সব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দূরে হওয়ার কারণে সে সবের মাত্রা আমরা ততটা অনুভব করিনি। এ ছাড়াও এ সময়ে ছোট এবং মাঝারি কয়েক দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। মাত্রা হিসেবে নেপাল, চীন ও ভারতের প্রায় অর্ধেক মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। নেপালের সমমাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে এবং হেলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সারা দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
বিগত ২০০ বছরে বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্পের মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প ও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের মতো আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আগের চেয়ে বাংলাদেশে ক্ষতি হবে বহুগুণ বেশি। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন রিখটার স্কেলের এক ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১, যা সর্বোচ্চ ১০ মাত্রায় পৌঁছে। সেটিরও উপকেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ সীমানার কাছাকাছি তৎকালীন আসাম ও আজকের মেঘালয়। এ ভূমিকম্পে ব্যাপক সম্পদহানি ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে ১ হাজার ৫৪২ জন মানুষ। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। বিগত বছরগুলোতে দেশে মৃদু ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পই হয়েছে অনেকবার। তাতে বড় ধরনের কোনো ধ্বংসযজ্ঞ না হলেও বিভিন্ন স্থানে ভবন হেলেপড়া বা ফাটল ধরার ঘটনা ঘটেছে। ভূমিধসও দেখা গেছে কোথাও কোথাও। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টা ২৮ মিনিটে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৩ মাত্রার মাঝারি ধরনের ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়। এসব ভূমিকম্প বাংলাদেশের বাইরের সীমানায় উৎপত্তিস্থল থাকায় ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ ক্রমান্বয়েই বড় ধরনের ভূমিকম্পের দিকে এগোচ্ছে। ছোট ছোট ভূমিকম্পগুলোই তার জানান দিচ্ছে। ২০২১ সাল ২৬ ডিসেম্বরও ভোরে ৬.১ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছে তা সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে বৈকি!
সরকারের তরফ হতে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়ার ন্যূনতম প্রস্তুতিও যে আমাদের নাই, তা স্পষ্ট। ব্যাপক অভাব জনসচেতনতাও তৈরি করা হয়নি। ভূমিকম্পের ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবে না। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সর্বদা আমাদের নিজেদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুটি। প্রথমত, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পপরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেওয়া।
পত্রিকান্তে বিশেষজ্ঞদের যে মতামত পাওয়া গেছে, তাতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আমাদের দেশে সুনামি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। তাদের মতে ৩টি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বঙ্গোপসাগারের কূলঘেঁষে বেঙ্গল বেসিনের প্রধান অংশে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে বড় ভূমিকম্প হবেই তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ভুমিকম্পের ব্যাপারে কেউই কোনো কিছু নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে সম্প্রতি যেভাবে দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে তাতে আতঙ্ক বাড়ে বৈকি? অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম খবর অনুযায়ী জানমাল রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্পের বেলায় সে সুযোগ নেই। ভূমিকম্প ঘটে হঠাত্ করে। ফলে জানমাল রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই ভূমিকম্পের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ বা ‘ডাক-কাভার’ পদ্ধতি। অর্থাত্ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন। তারপর কোনো শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন।
ভূমিকম্পের সময় কোন ফ্লোর নিরাপদ? অনেকে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। এটা ঐ জায়গার মাটির গঠন, বিল্ডিং কিভাবে তৈরি—এটার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করে। সাধারণত ভূমিকম্পের সময় চারভাবে ফ্লোর বা দালান ধসে পড়তে পারে। দালানের কোন্ তলা বেশি নিরাপদ—এক্ষেত্রে বেশিরভাগ মতামত যেটা পেয়েছি, তা হলো ভূমিকম্পের সময় ওপরের দিকের তলাগুলোতে দুলুনি হবে বেশি, নিচেরতলায় কম। কিন্তু দালান যদি উলম্ব বরাবর নিচের দিকে ধসে পড়ে, তবে নিচতলায় হতাহত হবে বেশি, কারণ ওপরের সব ফ্লোরের ওজন তখন নিচে এসে পড়বে। তাই ভূমিকম্পের সময় নিচে নামার চেষ্টা না করে যেখানে আছেন, সেখানেই সতর্ক অবস্থানে থাকুন। মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্পে প্রলয় ঘটে কয়েক সেকেন্ডে তখন কোনো সুযোগই আপনি পাবেন না।
৩। যে ফ্লোরেই থাকুন না কেন ভূমিকম্পের সময় বেশি নড়াচড়া, বাইরে বের হবার চেষ্টা করা, জানালা দিয়ে লাফ দেবার চেষ্টা ইত্যাদি না করাই উত্তম। একটা সাধারণ নিয়ম হলো—এসময় যত বেশি মুভমেন্ট করবেন, তত বেশি আহত হবার সম্ভাবনা থাকবে।
ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর-লিফট ব্যবহারও উচিত নয়। রাতে বিছানায় থাকার সময় ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকর্মী বলছে—গড়িয়ে ফ্লোরে নেমে পড়তে, এটা বিল্ডিং ধসার পার্সপেক্টিভেই। রেডক্রস বলছে, বিছানায় থেকে বালিশ দিয়ে কাভার নিতে, কারণ সিলিং ধসবে না, কিন্তু ফ্লোরে নামলে অন্যান্য কম্পনরত বস্তু থেকে আঘাত আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয়, দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজমান আছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোনো সময় সুনামিও হতে পারে। তাদের মতে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোন বরাবর ৬০০ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইসমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগরতলে হয়, তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে।
এ দুর্যোগ থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে পূর্ব প্রস্তুতি দরকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরুরি। তাই ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। জাতিসংঘের তৈরি ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের তালিকায় ঢাকা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। ভূবিদদের এক পরিসংখানে দেখা গেছে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যথাযথ উদ্যোগও নিতে হবে। যাতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখা যায়। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে।
লেখক :সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক