*রমজানের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না: চেম্বার সভাপতি
*আমদানিকৃত সকল পণ্য এসেছে: ছগীর আহমেদ
*তেল, ডাল ও গমের দর বাড়ার কারণ চীনারা: মীর হাসান
*১৭ মার্চ থেকে ট্রাক সেল বাড়বে: টিসিবি
*অসাধু ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা নিশ্চিত করতে হবে:ক্যাব
নাজমুল হোসেন
চট্টগ্রাম: এপ্রিলের মাঝামাঝিতেই শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এ মাসকে সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের আমদানি যেমন বেড়েছে, এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পণ্যের দামও। চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্য তেল, খেঁজুর, ছোলা সবকিছুই বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে।
ভোজ্যতেল বিক্রিতে আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী স্থানীয় মূল্য সমন্বয় করে সোমবার (১৫মার্চ ) নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তা মানছে না কেউ।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এক লিটার খোলা সয়াবিন মিলগেটে ১১৩ টাকা, ডিলারের কাছে ১১৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম মিলগেটে ১২৭ টাকা, ডিলারের কাছে ১৩১ টাকা, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৩৯ টাকা নির্ধারিত হয়। পাঁচ লিটারের বোতলজাত তেলের দাম মিলগেটে ৬২০ টাকা, ডিলারের কাছে ৬৪০ টাকা এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৬৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
খুচরা বাজারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে লিটারপ্রতি ১৩০ টাকার বেশি দামে। পাম সুপার ১১২ থেকে ১১৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ৫ লিটার সয়াবিন তেল (বোতল) বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ থেকে ৬৮০ টাকায়, নির্ধারিত দামের চেয়ে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি। পাইকারি পর্যায়ে একমাস আগে ৩ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি মণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম অয়েল ৩ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল মণপ্রতি ৪০০ টাকা বেড়েছে। গেল মাসে প্রতি মণ সয়াবিন তেল ৪ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তা এখন ৪ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ভোগ্যপণ্য আমদানির সংকট নেই। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমদানিকারকরাও বাড়তি দামে পণ্য আমদানি করছেন। পাশাপাশি রপ্তানিকারক দেশগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়া ও জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়া দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তারা।
ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ছোলায় কেজি প্রতি বেড়েছে ১০ টাকা। আগে কেজি প্রতি ৫৮ টাকায় বিক্রি হওয়া ছোলা এখন ৬৬ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের ছোলা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। খুচরা পর্যায়ে ছোলা কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। কেজি প্রতি ১০ টাকা বেড়ে মটর ডাল ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মটর ডাল মণপ্রতি বেড়েছে ৪০০ টাকা। ভালোমানের মসুর ডাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১২০ টাকায়, মাঝারি মানের মসুর ডাল ৭০ টাকায় এবং মোটা মসুর ডাল ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুগডাল ১০ টাকা বেড়ে কেজি প্রতি মানভেদে ৯০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিনিতে মনপ্রতি ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বিজনেসটুডে২৪ কে বলেন, রমজানে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা মোকাবেলায় যথেষ্ট পরিমাণে পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এপ্রিল মাসেও পণ্য আমদানি করা হবে। রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং সেল গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রমজানের বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করবেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মানে এই নয় যে কেউ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রমজানে অশুভ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে।

একই বিষয়ে চিটাগং চেম্বারের পরিচালক ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমেদ বিজনেসটুডে২৪ কে বলেন, দেশে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা ১৫ লাখ টন। প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ১০ হাজার টন ভোজ্য তেল লাগে। তার মধ্যে রমজানের চাহিদা আড়াই লাখ টন। চিনির বার্ষিক চাহিদা ২১ লাখ টন। তার মধ্যে রোজায় চাহিদা থাকে ৩ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ৬০ হাজার টন। চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। মসুর ডালের বার্ষিক চাহিদা ৪ লাখ টন। তার মধ্যে রোজার চাহিদা ৮০ হাজার টন। ছোলার বার্ষিক চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন। এর মধ্যে রোজার চাহিদা ৮০ হাজার টন। ডাল কয়েকদিন আগে ৬৩০ ডলার দিয়ে কিনলেও বর্তমানে ৬৫০ ডলার দিয়ে কিনতে হচ্ছে। ছোলার বুকিং ছিলো ৫৭০ থেকে ৫৮০ ডলার কিন্তু বর্তমানে ৬৬৫ ডলার দিয়ে বুকিং করতে হচ্ছে।

রমজানে পণ্য আমদানি সর্ম্পকে মেসার্স হাসান এন্ড ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী মীর মো.হাসান বিজনেসটুডে২৪ কে বলেন, আর কয়েক দিন পরে রমজানের বেচাকেনা শুরু হবে। এবার তেল ও চিনির দাম আরোও বাড়বে। যা আমদানি হচ্ছে তা সরবরাহ হয়ে যাচ্ছে। চীনারা হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ভোজ্য তেল, চিনি, মসুর ডাল কিনায় এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। তবে রোজার আগেই বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখনো কমে নি। সেই সাথে জাহাজভাড়া বাড়ায় আমদানি খরচও বেড়েছে। রপ্তানিকারক দেশগুলোতেও পণ্যের উৎপাদন কমে গেছে। সবমিলিয়ে আমাদের দেশীয় বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বেড়েগেলে আমরা আমদানি করি কম। তবে গেল বছরের মতো এ বারও নিত্যপণ্য মজুদ রাখা হবে। তবে, দাম একটু বেশি থাকবে। গেল বছর যে তেল ৩ হাজার টাকায় কিনেছি এই বছর সেই তেল কিনতে হচ্ছে ৪ হাজার টাকারও বেশি। আবার ২২ শ’ টাকার চিনি এই বছর কিনতে হচ্ছে ২৪ শ’ টাকায়। তবে, ২ থেকে ৩ টি পণ্যের দাম বেশি থাকলেও পেঁয়াজ, রসুন, আদা, কিসমিসের দাম কম থাকবে। ইতোমধ্যে চালের দাম বেড়েছে বস্তা প্রতি ৮ ‘ টাকা করে। গেল বছর যে চালের বস্তা ২৪শ’ টাকায় পাওয়া যেতো এই বছর তা ৩৪শ’ টাকা।
এপ্রিল মাসে যখন নতুন ক্রপ আসবে তখন দাম কিছুটা কমবে। তবে মার্চে তেলের দাম কমবে না। এপ্রিল মাসে কমতে পারে। জুন-জুলাই থেকে গমের দাম কমতে পারে। চিনি মে মাস থেকে দাম কিছুটা কমবে বলে জানান মীর মো.হাসান।
ইতোমধ্যে রমজানের জন্য আমদানিকৃত পণ্য চলে এসেছে। রমজানের বাজারে সরকারের কঠিন মনিটরিং প্রয়োজন। তবে ব্যবসায়ীদের হয়রানী করে মনিটরিং নয়। করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই। তাই সরকারের উচিত আমদানিকৃত পণ্যের খরচ বিবেচনা করে পণ্য গুলোর দাম নির্ধারণ করে দেওয়া। তাহলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে বলে জানান তিনি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতিবছর রোজা আসলেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করে। দীর্ঘদিন ধরে চাল, ডাল, ছোলা, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে নগদ অর্থ দণ্ডের পাশাপাশি প্রয়োজনে জেল-জরিমানা নিশ্চিত করতে হবে।
টিসিবি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান জামাল উদ্দিন বলেন, বর্তমানে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ২০টি ট্রাকে খোলা বাজারে স্বল্পমূল্যে ভোগ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এসব গাড়িতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ৯০, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৫৫, প্রতি কেজি চিনি ৫০ ও প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। রমজানকে সামনে রেখে ১৭ মার্চ থেকে ট্রাক সেল আরও বাড়ানো হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, খাতুনগঞ্জে বাড়তি দামে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হচ্ছে এমন অভিযোগ পাচ্ছি। ভোগ্যপণ্যের বাড়তি দাম দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। তাই পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে অতি শীঘ্রই বাজার মনিটরিং শুরু হবে। এ সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপও তৈরি করা হবে।