হজের সময় লাখ লাখ মানুষের সমাগম থাকে সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা। ফলে চাঙা হয়ে উঠে সেখানকার ব্যবসায় কর্মকাণ্ড।
গাড়ি সার্ভিস, ফুড ডেলিভারি, ছোটোখাটো দোকান থেকে শুরু করে একেবারে বিলাসবহুল হোটেল- সব জায়গায় ক্রেতা ও ভোক্তাদের বিপুল চাহিদা দেখা যায়। তবে এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে যুগ যুগ ধরে হজের মৌসুমে সৌদি আরবে চলে আসা এই ব্যবসা বাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমে এসেছে।
প্রতি বছর পুরো বিশ্ব থেকে প্রায় ২৫ লাখের মতো মানুষ হজ করতে সৌদি আরব যান। এবার মহামারির কারণে সীমিত পরিসরে হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মাত্র ১০ হাজারের মতো মানুষ হজ করার অনুমতি পেয়েছেন। এর ফলে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতে। এ নিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যুক্তদের সঙ্গে কথা বলেছে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
মক্কায় পবিত্র কাবা বা মসজিদ আল-হারামের কাছেই তার ট্যাক্সি বুকিং অফিসে বসে বলছিলেন সাজ্জাদ। তিনি বলেন, এখানে কোন কাজ নেই , চাকরি নেই, বেতন নেই- কিচ্ছু নেই। সাধারণত হজের দু-তিন মাস আগে থেকে শুরু করে আমি এবং এখানকার ড্রাইভাররা কয়েক মাসে যে পরিমাণ টাকা উপার্জন করে তাতে তাদের বাকি বছরটা চলে যায়। কিন্তু এখন? কিছুই নেই।
সাজ্জাদের প্রতিষ্ঠানে গাড়ির ড্রাইভারদের অনেকেই অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করছেন তিনি। তারা মক্কার জনপ্রিয় ওয়াচ টাওয়ারের আশপাশের রাস্তাগুলোর যানবাহনের ভিড় কেমন সে সম্পর্কে আপডেট পাঠান।
সাধারণত হজের সময় এলাকাটা হাজিদের ভিড়ে এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাস্তায় থাকে তাদের কাফেলা, পরনে তাদের সাদা পোশাক, মাথায় সৌদি আরবের প্রচণ্ড গরম থেকে আত্মরক্ষার জন্য ছাতা। কিন্তু এখন ড্রাইভারদের যানবাহনগুলো যাত্রীশূন্য। শহরটাকে দেখাচ্ছে প্রায় একটা ভূতুড়ে নগরীর মতো সাজ্জাদের ড্রাইভাররা বরং রাস্তায় জমা হওয়া কবুতরদের ছবি পাঠাচ্ছেন- মানুষের চেয়ে রাস্তায় তাদের সংখ্যাই যেন বেশি।
তিনি বলেন, আমার ড্রাইভাররা খেতে পাচ্ছে না। তারা এখন একটা ছোট্ট ঘরে চার-পাঁচজন করে থাকছেন, যেসব ঘরে বড়জোর দুজন লোক থাকতে পারে। আপনি সরকারি কোন সাহায্য পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে আট বছর আগে পাকিস্তান থেকে আসা এ ব্যবসায়ী বলেন, না। কিছুই পাইনি, একেবারেই কিচ্ছু না। আমার কিছু সঞ্চয় আছে যা ভেঙে এখন চলছি। কিন্তু আমার এখানে অনেক লোক কাজ করে- ৫০ জনেরও বেশি। তারা প্রচণ্ড দুর্দশার মধ্যে আছে।
সাজ্জাদ বলেন, গতকালই আমার এক বন্ধু ফোন করেছিল। সে বললো, দয়া করে আমাকে কিছু একটা কাজ দাও, যত কম বেতনেই হোক। বিশ্বাস করুন, এসব কথা বলতে গিয়ে লোকে কাঁদতে শুরু করে। এ বছরের হজকে কেন্দ্র করে এখানে কঠোর সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক আকারে সংক্রমিত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, কভিড-১৯ বিস্তার ছড়ানো ঠেকাতে তারা বছরের এই সময়টায় যে লাখ লাখ হজযাত্রী আসেন – তার সংখ্যা ব্যাপকভাবে সীমিত করেছে। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। শুধুমাত্র যারা আগে থেকেই সৌদি আরবের বাসিন্দা তারাই হজ করতে পারবেন।
হজের ওপর বিধিনিষেধের কারণে মক্কা ও মদিনা শহরের অর্থনীতিতে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, কারণ হজযাত্রীদের আগমনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর এই দুটি শহরে শত শত কোটি ডলার সমপরিমাণের ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। রাজধানী রিয়াদের আল-রাজি ক্যাপিটাল নামে একটি আর্থিক সেবাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বিভাগের প্রধান মাজেন আল-সুদাইরি বলেন, এটা ঠিক যে হজের আয়োজন করতে প্রতি বছর সৌদি সরকারের যে অর্থ ব্যয় হয় তার অনেকটাই এবার বেঁচে যাবে। কিন্তু মক্কা এবং মদিনা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হবে তার পরিমাণ হতে পারে ৯০০ থেকে ১২০০ কোটি ডলার পর্যন্ত। হজের সীমিত আকার এবং এসব বিধিনিষেধের প্রভাব পড়েছে সৌদি আরবের বাইরেও। এসময় যে লাখ লাখ হজযাত্রী আসেন তাদের খাবা- বিশেষত মাংসের চালান আসে প্রতিবেশী দেশ কেনিয়ার মত দেশগুলো থেকে।
সেখানকার কৃষকেরা এজন্য প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ গবাদিপশু পালন করেন- এবছর তা অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। কেনিয়ার লাইভস্টক প্রডিউসার এ্যাসোসিয়েশনের প্যাট্রিক কিমানি বলেন, কেনিয়ার গবাদিপশু খাতে অনেক টাকার ব্যবসা হয়। কেনিয়ার বহু পরিবারের অর্থসংস্থান হয় এ থেকে। হজকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ কৃষকের জন্যই গবাদিপশু পালন তাদের জীবনধারার অংশ হয়ে গেছে।
কিমানি বলেন, তার সমিতির সদস্যরা হজের জন্য সৌদি আরবে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার গরু রপ্তানি করে। কিন্তু এ বছর তাদেরকে সেই মাংস স্থানীয় বাজার ও কোল্ড স্টোরেজগুলোয় পাঠাতে হচ্ছে। গত বছর সৌদি আরবে হজের জন্য সবচেয়ে বেশি বিদেশী হাজি গিয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে। কিন্তু এবার করাচির একটি ট্রাভেল এজেন্সি ‘চীপ হজ এ্যান্ড ওমরা ডীলস’-এর মালিক শাহজাদ তাজ বলছেন, তার ব্যবসা এখন লাটে ওঠার মুখে।
তিনি বলেন, ব্যবসা এখন কার্যত শূন্যের কোঠায়। এমনকি ভ্রমণ-সংশ্লিষ্ট অন্য যে সব কর্মকাণ্ড যেমন ফ্লাইট, জিনিসপত্র আনা-নেয়া, পণ্য ডেলিভারি সবই বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের কিছুই করার নেই। এমন অবস্থার জন্য আমরা আদৌ তৈরি ছিলাম না। পাকিস্তানি এ ব্যবসায়ী বলেন, আমরা আমাদের স্টাফের সংখ্যা কমিয়ে একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। এখন আমরা বাড়ি-গাড়ি বা জমিজমার মতো সম্পত্তি বিক্রি করার মত অবস্থায় পৌঁছে গেছি – যাতে কোনমতে এই সময়টা পার হতে পারি।
-বিবিসি