Home বিশেষ সাক্ষাৎকার আ’লীগ নেতা বেলায়েত এখন রাজনৈতিকভাবে বেকার

আ’লীগ নেতা বেলায়েত এখন রাজনৈতিকভাবে বেকার

হালিশহরের বাড়িতে এ কে এম বেলায়েত হোসেন

‘আজকে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্য পদ দিয়ে ব্যবসা করা। রাজনীতিকে টাকা কামানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন তারা।

নাজমুল হোসেন

চট্টগ্রাম:  মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট বিমা ব্যক্তিত্ব এ কে এম বেলায়েত হোসেনের  রাজনীতির হাতে খড়ি অষ্টম শ্রেনীতে থাকা অবস্থায়। রাজনীতির  বৈতরনী পাড়ি দিয়ে তিনি হয়ে উঠেন চট্টল বীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর আস্থাভাজন।

দলের কঠিন সময়ে হাল ধরেও এই ত্যাগী নেতা, দলের সুসময়ে এসে বার বার লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন।

হালিশহরের বাসভবনে বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধির সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালে অষ্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় সন্দ্বীপ ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন ছিল। সে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগের এক পুরাতন জমিদার নেতা। তিনি ২৪ বছর ধরে ঐ ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু এলাকার মানুষ তাকে পছন্দ করত না। তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, প্রতিবাদ করবে এমন সাহস কেউ করতো না। “জনকল্যাণ সমিতি” নামে একটা সমিতি গঠিত হলো। তারা ১১ জনের প্যানেল করে তার বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড় করালো। সে নির্বাচনে একটা প্যানেল ৩টা ওয়ার্ডে নয় জন মেম্বার, একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একজন প্রেসিডেন্ট করে একটা নতুন প্যানেল দাঁড় করালো । আর ওদের মুসলিম লীগের একটা প্যানেল ছিল।

‘কাটগড় গোলাম রুমী হাই স্কুলে’ হেডমাস্টার ছিলেন বাবু কালীপ্রসন্ন দাশ। তার সাথে মুসলিম লীগের নেতা গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন স্কুলের সেক্রেটারি। তাদের সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। তখন হেডমাস্টার কালীপ্রসন্ন বাবু আমাকে দিয়ে নির্বাচনের কাজ করালেন ঐ প্যানেলের পক্ষে। জমিদার চৌধুরী সাহেবের বিপরীত প্যানেলের পক্ষে কাজ করলো এবং পূর্ণ প্যানেলে জয় লাভ করলো। পরবর্তী পর্যায়ে সে জমিদার সাহেব হেরে গেলেন তারপর আমার বিরুদ্ধে নানা রকম ষড়যন্ত্র  শুরু হয়ে গেল। ৯ম শ্রেণী থাকা অবস্থায় আমাকে স্কুল থেকে বহিঃষ্কার করা হলো। সেই বহিঃষ্কৃার সার্টিফিকেটে কালী বাবু নিজেই স্বাক্ষর করেন। যদিও পরবর্তীতে উনি আমাকে একটা ভালো সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।

*স্বচক্ষে পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য দেখলাম

তারপর আমি সন্দ্বীপ ত্যাগ করে হাতিয়া’য় স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করি। ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হতে আসলাম ইন্সটিটিউট অফ আইএএ। সেখানে তখন এয়ার পাইলটের ইন্টারভিউ চলছিল। যার যোগ্যতা ছিল মেট্রিক উইথ সায়েন্স ২য় বিভাগে পাস। আমার সব ঠিকঠাক ছিল তাই আমিও পরীক্ষা দিয়ে রিটেন আর ভাইভা মিলিয়ে থার্ড হয়ে গেলাম।

তখন আমি পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোন কোটা ছিল না। তখন আমি স্বচক্ষে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য দেখলাম। আমি আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় বুঝলাম পূর্ব পাকিস্তানের কোন অধিকার পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাছে নেই। ওরা তাদের অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে আমাদের গণ্য করতো।

আমার বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়। আমি আমার আত্মীয়ের সহযোগিতায় রংপুরের সৈয়দপুরের একটি কলেজে ভর্তি হই। আমার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের যে বিষ ঢুকেছিল, আর্থিক অনটনে থেকেও আমি ছাত্র সংসদের রাজনীতিতে যুক্ত হই। এরপর বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার কারণে আমাকে কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষ হতে ডিবি এসে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে যায়। এই গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করেন কয়েক জন বাঙ্গালী প্রফেসর।

সৈয়দপুরের ডিআইজির মাধ্যমে পরবর্তীতে আমি মুক্তি পাই। এর পরের সকল আন্দোলনে আমি সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করি।

১৯৬৫ সালে  বিএ পাস করে আমি আমার জন্মভূমি সন্দ্বীপে এসে একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। বিয়ে করি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার স্ত্রী মারা যায়। 

সন্দ্বীপ থানা আওয়ামী লীগ কমিটি গঠনে যে কয়জন সহযোগী ছিলেন তার মধ্যে আমি একজন।

 বঙ্গবন্ধু নিজেই ইন্সুরেন্সে চাকরি করেন, সুতরাং তোমার সমস্যা হবেনা

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর এম এ আজিজ ও এম আর সিদ্দিকী সাহেব আমাকে বলেন, শিক্ষকতা করে রাজনীতি করা তোমার পক্ষে ঠিক হবে না। তুমি চলে আসো তোমাকে ইন্সুরেন্সের চাকরি দেব। তখন আমি বললাম এমনতো হয় না। তখন এম আর সিদ্দিকী বললেন , ‘যে বঙ্গবন্ধু নিজেই ইন্সুরেন্সে চাকরি করেন, সুতরাং তোমার সমস্যা হবেনা’।

*সুসময়ে আমি রাজনৈতিকভাবে বেকার

পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে আমি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হই। আমি আমার পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি সংগঠকের ভূমিকা পালন করি। আর আওয়ামী লীগের এই সুসময়ে আমি রাজনৈতিকভাবে বেকার। তখন যারা সক্রিয় ছিল না তারা এখন রাজনীতির মাঠে সরব। আমি কখনো কারো কাছ থেকে কোন কিছু পাবার আশায় রাজনীতি করি নাই, কখনো কারো কাছ থেকে চাঁদা তুলি নাই। পাকিস্তানের যে বৈষম্য সে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমি রাজনীতি করেছি, আমি রাজনীতি করেছি দেশের উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে জীবিত রাখার জন্য।

*উপদেষ্টা কোনো পদই না

বর্তমানে আমি উপদেষ্টা হিসেবে আছি।  কিন্তু আসলে উপদেষ্টা কোনো পদই না। আওয়ামী লীগকে ভালবাসি, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি সে কারণেই রয়েছি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং আশেপাশে যারা আমাকে চিনে সবাই আমাকে সম্মান করে।

*রাজনৈতিক নেতা চাকরি করে গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা এমন নজির নেই

চাকরি করে আমি আল্লাহর রহমতে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি যেটা ১৯৯২ সাল থেকে এমপিওভুক্ত আছে । একজন রাজনৈতিক নেতা চাকরি করে একটি গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে এমন নজির বাংলাদেশের কোথাও নাই।

দলীয় অপশক্তির কারণে পদ পাইনি

১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে আমাকে সদস্য করা হয়।  পরবর্তীতে আমাকে তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আমাকে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজনীতি করার কারণে আমি চাকরিতে প্রমোশন পাইনাই। এমনকি রাজনীতি করার কারণে আমার ছেলেকে একটি খুনের মামলার আসামি করা হয় এবং সে  মামলায় অ্যারেস্ট হয়ে ১৪ দিন জেলে ছিল এবং সে সময় আমরাও আমাদের নিজের বাসায় থাকতে পারতাম না। একেকদিন একেক জনের বাসায় আত্মগোপনে থাকতাম। এতকিছুর পরও আমি রাজপথ ছাড়ি নাই। রাজনীতি ছাড়ি নাই। দলীয় অপশক্তির কারণে পদ পাইনি।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। আমার সাথে মহিউদ্দীন চৌধুরীর পরিচয় হয় ১৯৭৬ সালে। রাজনৈতিক পথ চলা সম্পর্কে আমার এলাকার এবং এমএজি সাহেবের মাধ্যমে মহিউদ্দীন চৌধুরী জানতে পারেন আমার সম্পর্কে  এবং পরবর্তীতে আমাকে একটিভ ওয়ার্কার হিসেবে গ্রহণ করেন।

এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী যখন জেলে, তখন আমি তার সকল কাজ সততার সাথে করেছি। আমি পদে থাকি আর না থাকি সেই কাজগুলো করে আওয়ামী লীগের সাথে ছিলাম। ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন সবাই জেলে ছিল তখন আমি মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করি। আমি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের বিভিন্ন আন্দোলনে ছিলাম।

শত কোটি টাকা খরচ করে এমপি হতে চাই না

আমি শত শত কোটি টাকা খরচ করে এমপি  হতে চাই না। দল যদি চায় তাহলে আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হয়ে নির্বাচন করতে চাই এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চাই।

আমার জন্মভূমি সন্দ্বীপ। চট্টগ্রাম ১০ নির্বাচনী এলাকা পছন্দ। আমি বলছি না নমিনেশন দিতে হবে কিন্তু যদি আমাকে নমিনেশন দেয় এই দুই আসনের যে কোন একটি থেকে আমি নির্বাচন করতে রাজি আছি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন করতে আমি পারবো না। 

আমার রাজনৈতিক অর্জন হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে আমার আশেপাশে যারা আমাকে চেনে তারা সবাই আমাকে স্নেহ করে, সম্মান করেন । যদিও রাজনীতি করে আমি কখনো কোন কিছু পাইনি। এরপরও জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যদি কখনো কোনো দায়িত্ব অর্পণ করে আমি সেই দায়িত্ব মাথা পেতে নিব এবং আমার জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব দেশ এবং মানুষের সেবা করে যাব।

রাজনীতি এখন আর রাস্তায় নেই। রাজনীতি এখন থিয়েটার ইনস্টিটিউটের মধ্যে ঢুকে গেছে। লালদীঘির ময়দান ৭ বছর ধরে কি ঘুমিয়ে আছে। সেখানে কোনো শ্রমিক জনসভা, আওয়ামী লীগের জনসভা হয় না, সেখানে গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কোন জনসভা হয় না। মহানগর আওয়ামী লীগের নিজেস্ব কিছু কার্যক্রম থাকতে হবে এলাকা ভিত্তিক। এলাকাভিত্তিক সে সব সমস্যা সেগুলোকে সমাধান করতে হবে।

সবাই রাজনীতি করে জনগণের সেবা করার জন্য। জনগণের সেবা করতে আমিও এমপি ইলেকশন করতে চাই। তবে কোনো লবিং করে নয়। আমি লবিং করে নেতা হতে চাইনা। আমি বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক। এটা আমি মুখে বলতে চাইনা, আমার অন্তর জানে।

আমি রাজনৈতিক পদ দিয়ে ব্যবসা করতে চাইনা। আজকে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্য পদ দিয়ে ব্যবসা করা। রাজনীতিকে টাকা কামানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন তারা।

আল্লাহ আমাকে অভাব দেয়নি। আমার সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমার বড় ছেলে জয়েন্ট সেক্রেটারি, বড় মেয়ে কাউন্সিলর, মেজো ছেলে লন্ডনে থাকে এবং ছোট মেয়ে শিক্ষকতা করে। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত।

*লোকে বলে আমার বয়স ৪০!

আমার এই ৭৯ বছর বয়সেও আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছে। অনেকে বিশ্বাস করে না আমার এতো বয়স হয়েছে। এখনও যখন প্রোগ্রাম করতে যাই মানুষ বলে আমার বয়স ৪০ থেকে ৪৫ বছর। 

এই বয়সে  যদি দল আমাকে কোনো দায়িত্ব দেয় তা আমি আমার সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে পালনের চেষ্টা করবো। 

কোনো দিন পদ পদবীর জন্য অনুরোধ করিনি। ত্রিশ বারেরও বেশি মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলাম।

*সারাদিন বই পড়ি

সারাদিন বই পড়ে সময় অতিবাহিত করি। আমি বিশ্বাস করি দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শেখা যায়। তাই আমি এখনও রাজনীতির বই পড়ে রাজনীতি আয়ত্তে আনতে চাচ্ছি।