॥ সেলিনা শিউলী ॥
ঢাকা: ‘চ্যারিটি বিগিনস এ্যাট হোম’ কথাটি যেন উত্তরা আজমপুরের বাসিন্দা মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ’র বেলাতেই প্রযোজ্য। মুগ্ধ খাঁটি মানুষ আর দেশপ্রেমিক হতে চেয়েছিলেন। ঘর থেকে বাইরে সব জায়গায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে অন্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখতেই নিজেকে সদাব্যস্ত রাখতেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই মুগ্ধ ছিলেন ভিন্ন স্বভাবের। স্পষ্টবাদী আর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হাস্যোজ্জ¦ল মুখে ছিল কাঠিন্যের ছোঁয়া। মুখের কথা সহজেই বলে দিতে ভালোবাসতেন তিনি। আর তার সরল ব্যবহার এবং দায়িত্বশীলতায় মুগ্ধ হতেন সবাই। আপোষহীনতা ছিল তার ব্যক্তিত্বে। চৌকস আর মেধাবী মুগ্ধ একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, দক্ষ ফ্রিল্যান্সার আর পরোপকারী মানুষ হতে চেয়েছিলেন। তার প্রিয় উক্তি ছিল ‘বাবু মশাই জিন্দেগী বঢ়ি হ’না চাহিয়ে; লাম্বি নেহি’।
শহিদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ’র জন্ম ঢাকার উত্তরায় ১৯৯৮ সালের ৯ অক্টোবর। মুগ্ধ’র পিতার নাম মোস্তাফিজুর রহমান এবং মায়ের নাম শাহানা চৌধুরী। তিন ভাইয়ের মধ্যে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ জমজ ছিলেন।
মুগ্ধ’র বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসকে জানান, আমাদের তিন ভাইয়ের দেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল খুব। সে স্বপ্ন দেখতো তার ‘বাম্বুল বি’ স্টিকার দেওয়া প্রিয় বাইকটি নিয়ে দেশের ৬৪ জেলার সার্কিট হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে। সে সব জেলার মানুষদের সঙ্গে মিশবে, সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে জানবে ও বুঝবে। এ জন্য নিজস্ব ব্লগিং পেজের কাজ শুরু করেছিল। অনেক ভিডিও করে রেখেছিল। কারণ ওর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে নানা জানা ও অজানা তথ্য ও ভিডিও দেশের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া। ইতোমধ্যে ৩৪ টি জেলা ঘুরেছে সে।
তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে স্ত্রী ও দু’ভাইকে নিয়ে দেশের শ্রীমঙ্গল ও কাপ্তাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় আমরাও ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার ভাই মুগ্ধ তার সে স্বপ্ন আর পূরণ করে যেতে পারলো না।
গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে শিক্ষার্থীদের ডাকা কোটা সংস্কার আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে শহিদ হয়েছিলেন ২৫ বছর ৯ মাস বয়সী মুগ্ধ। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালায়। তার একটি গুলি মুগ্ধ’র কপালে লেগে ডান কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে, গুলিবিদ্ধ মুগ্ধকে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছু আগেও ‘কারও পানি লাগবে ভাই? পানি লাগলে নেন’ এই কথা বলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের কাছে ছুটে যাচ্ছিলেন আর পানি ও বিস্কুট বিতরণ করছিলেন। এক পর্যায়ে বন্ধুর সঙ্গে একটু বসেছেন, এমন সময়ে পুলিশের একটি গুলি এসে তার কপালে লাগে। পরক্ষণেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। আন্দোলন আর মানবতার প্রতীক হয়ে ওঠা মুগ্ধ’র সাহসিকতা ও বীরত্বের গল্প কেবল দেশেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়েও।
দীপ্ত বলেন, ‘আমরা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ যমজ ভাই। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ হাসিখুশি ছিলো মুগ্ধ। আদর ও শাসনে পরিবারে বেড়ে উঠেছি সবাই। তিনজনই খেলাধুলা পছন্দ করি। মগ্ধ খুবই ভাল স্পোটর্স ম্যান। মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ ডিভিশনাল ফুটবল খেলেছে। দুটো ফুটবল ক্লাবের হয়ে নিয়মিত খেলতো তারা। বিকেলে আসরের নামাজের পর এবং মাগরিবের আজানের আগে খেলাশেষে বাসায় আসার হুকুম ছিল। আমরা নির্ধারিত সময়ের আগে খেলতে যেতাম। সেজন্য একতলা বাড়ির ছাদের গেট বাইরে থেকে বন্ধ করে ছাদ বেয়ে খেলতে চলে যেতাম। এমন ধরনের সম্পর্ক আমাদের।’
তিনি আরো বলেন, মুগ্ধ মায়ের খুব ক্লোজ ছিল। আমাদের তিন ভাইয়ের সমপরিমাণ টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে হতো মাসের শুরুতে। আমরা দুই ভাই যা দিতাম তার সঙ্গে আরো ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, ‘ভাইয়া আর আব্বু যেন না জানে, এটা তোমার হাত খরচ।’
দীপ্ত বলেন,‘আম্মার হেয়ারিং এইডের প্রয়োজন পড়ে, তিনি বাসায় থাকলে এটি ব্যবহার করেন না। সে কারণে একটু কম শুনতে পান। তো আম্মা যাতে মনে কষ্ট না পান সে কারণে বাসায় থাকলেই মুগ্ধ নিয়ম করে তার কাছে গিয়ে বলতো, ‘আম্মু নামাজের সময় কি হয়েছে? তখন আম্মু ঘড়ি দেখে বলতো হ্যাঁ নামাজের সময় হয়েছে, নামাজ পড়বো।’
তিনি বলেন, মুগ্ধ খুব সাধারণ জীবনযাপন করতো। উপার্জনের একটা অংশ প্রতিমাসে বাঁচিয়ে রাখতো, যাতে দান করা যায়। এর আগেও যেমন পানি ও বিস্কুট নিয়ে সেবা করেছিল, তেমনি সেদিনও পানি ও বিস্কুট নিয়ে গিয়ে তা বিলি করছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। নানা গুণের অধিকারী ছিল সে। লেখাপড়ার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়েও সক্রিয় ছিলো মুগ্ধ। মাসে সে আড়াই হাজার থেকে তিনহাজার ডলার আয় করতো ফ্রিল্যান্সিং থেকে।
চতুর্থ শ্রেণি থেকেই মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ স্কাউটিং করতো বলে জানান দীপ্ত।
দীপ্ত আরো জানান, তিনি স্কাউটিং করতেন বিএনসিসিতে। এ ক্ষেত্রে বাবা উৎসাহ দিতেন। বাবা সীমিত আয়ের মধ্য থেকেই অর্থ দিতেন ক্যাপিংয়ে যেতে আর দূগর্তদের সাহায্য করতে। মুগ্ধ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার ছিলো। ২০১৯ সালে বনানী অগ্নিকাণ্ডের সময় পানি ও বিস্কুট নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারকাজে সহায়তা করায় বাংলাদেশ স্কাউট থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে মুগ্ধ।
তিনি বলেন, ‘যে কোন প্রফেশনকে সম্মানের চোখে দেখার শিক্ষা আমরা পারিবারিকভাবে পেয়েছিলাম। বাবা হেলথ ইন্সেপেক্টর ছিলেন। অবসর নিয়েছেন। আমাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আমাদের সবার জন্ম উত্তরায়। এখন প্রিয়াংকা সিটিতে আমাদের চাচা একটা বাড়ি করেছেন, আমরা সবাই বিভিন্ন ফ্লোরে থাকি।’
মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক শেষ করে গত মার্চে ঢাকায় আসেন। এরপর বিইউপিতে (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস) এমবিএতে ভর্তি হন। স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা নিতে নেদারল্যান্ডস যাবেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের গণিত বিভাগের প্রধান প্রফেসর মো. আজমল হুদা বাসসকে বলেন, মেধাবী মুগ্ধ ১৯ ব্যাচের ছাত্র ছিল। স্নাতকে ভালো ফলাফল করেছিল। ওর সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে চতুর্থ বর্ষে। ওদের স্টাডি ট্যুরে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নয়, সে সময় গাইডের দায়িত্বে ছিলাম। কাছাকাছি এসেছিলাম। যে দু’তিনজন শিক্ষার্থীদের এই সফরে দায়িত্বে ছিল তাদের মধ্যে মুগ্ধ একজন।
তিনি বলেন,মাস্টার্স করার জন্য ও ঢাকায় গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলেছিল তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। একটা রিমার্কেবল বিষয় ছিল যে সে সবসময় হাসতো। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় করতো। মুগ্ধ একজন ভিন্নমাত্রার ছাত্র ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের।
যেদিন মুগ্ধ শহিদ হয়েছে সেদিন সন্ধ্যায় তার ব্যাচম্যাটরা হাউমাউ করে কাঁদছিল। ওর একজন কাছের বন্ধু এবং খুবি’র একজন ছাত্র ঘটনাস্থলে ছিল, ওর সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখছিলাম।
তিনি বলেন, আমরা একজন ভাল মনের শিক্ষার্থীকে হারিয়েছি। এই শূন্যস্থান কখনও পূরণ হবার নয়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে কজন অগ্রবর্তী সৈনিক তাদের জীবন দিয়েছিলেন মুগ্ধ তাদের অন্যতম। তাদের আত্মত্যাগের কারণে আন্দোলন বেগবান হয়ে শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। যার পরিণতিতে ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশ হয়েছে স্বৈরাচারমুক্ত।
এ দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে মুগ্ধ’র নাম উজ্জ্বল পংক্তিতে লেখা থাকবে। জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে মানববিকতার প্রতীক হয়ে ওঠা মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধকে। তার স্মরণে ইতোমধ্যে ঢাকার উত্তরায় বঙ্গবন্ধু মুক্তমঞ্চের নাম পরিবর্তন করে ‘মুগ্ধমঞ্চ’ রাখা হয়েছে।
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দেয়া মুগ্ধরা এ দেশের মানুষের মনে চেতনার আলোক হয়ে বেঁচে থাকুক হাজার বছর এমনটাই চাওয়া সকলের।
-বাসস