রত্না ভট্টাচার্য্য
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য
কলকাতা: ছোটবেলায় পাড়ায় ঐতিহাসিক যাত্রাপালায় খুব মজা পেতাম। রঙিন পোশাক পরে মাথায় মুকুট, কোমরে তলোয়ার নিয়ে বিভিন্ন চরিত্রগুলো কেমন যেন বাস্তব হয়ে উঠত! চরিত্রগুলো দেখব বলে একটু বড় হতে বাড়িতে থাকা স্বাধীনতার আগে কেনা সাইকেলটা নিয়ে একা-একা মুর্শিদাবাদে গেলাম। সালটা ১৯৮১, অবহেলায় পড়ে আছে বাংলার নবাবি আমল। এখনকার মত এমন সেজেগুজে ওঠেনি। একটা ঘোরের মধ্যে মশগুল হয়ে গেলাম। এখনও সময় পেলে ঘুরে আসি মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামত এলাকা।
ক’দিন আগে গিয়ে কেল্লা নিজামত এলাকার মধ্যে একটা চায়ের দোকানে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখা পুরনো গাইড গোপালদার সঙ্গে।
–কবে এলেন দাদা?
–এই তো কাল সন্ধ্যায়।
–এবারেও কি গঙ্গার ধারে হেঁটে, পুরনো বাড়িগুলোর সিঁড়িতে বসে কাটিয়ে দেবেন?
–ওই আর কী! তুমি কি এখন ফাঁকা আছ, দাদা!
–সারাদেশ জুড়ে অস্থিরতা চলছে, তাই লোকজন কম আসছে। তাই একদম ফাঁকা।
–চলুন আপনার সাথে হাঁটব, আর আপনি গল্প বলবেন। এই কেল্লা নিজামত এলাকার মধ্যেই হেঁটে ঘুরব, বসব, চা খাব, আবার হাঁটব।
–বেশ, বেশ চলুন দাদা।
গঙ্গার ধার থেকে উঠে হাজারদুয়ারি, ইমামবাড়া চত্বরকে ফেলে রেখে মূল প্রবেশপথের সামনে এসে ডানদিক ধরে হাঁটতে শুরু করলাম দু’জনে।
গোপালদা বলে চলেছেন, এটি হল কেল্লা নিজামত এলাকা, মুর্শিদাবাদের নবাবদের নিজস্ব এলাকা। এখানে নবাবদের নিজস্ব প্রাসাদ, দরবার ভবন, ধর্ম উপাসনা ক্ষেত্র, প্রমোদ উদ্যান প্রভৃতি ছিল এই প্রাসাদের এলাকার মধ্যে। এ ছাড়া এই প্রাসাদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পেশার মানুষদের জন্য আলাদা আলাদা বসতি, বাজার, হাতিশালা, আস্তাবল, সমাধিক্ষেত্র প্রভৃতি গড়ে উঠেছিল প্রাসাদের আশপাশে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি নবাব বাহাদুর রোডে।
–এই দেখুন সামনে এটি নওশের বানুর সমাধি ও মসজিদ। নওশের বানু ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁর স্ত্রী। তাঁদের পরিবারের অন্যদের মত এনার সমাধিও ওই মসজিদের সিঁড়ির নিচে। একটু এগিয়েই দেখা গেল জুতাপট্টির তোরণদ্বার। এই রকম গেট বা তোরণ অনেকগুলি আছে এই এলাকায়, সবগুলির ইতিহাস জানা যায় না। জুতাপট্টি এলাকায় ছিল চর্মকারদের বাস। নবাব পরিবার ও সেনাবাহিনীর জন্য চামড়াজাত দ্রব্যের কাজ এরা করতেন। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখালেন নজর আলি খান এস্টেট। এখানে প্রাচীন প্রাসাদোপম অট্টালিকা, ইমামবাড়া প্রভৃতি রয়েছে, চারিদিকে তার ইতিহাসের গন্ধ।
কয়েক-পা হাঁটতেই এল নহবত গেট বা ত্রিপোলিয়া তোরণ। এখানেই টাঙ্গাওয়ালাদের স্ট্যান্ড। নবাব সুজাউদ্দিনের সময়ে এটি তৈরি। অতীতে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় নহবত বাজত। তোরণ পেরিয়ে ডানদিকে ছিল কেল্লা নিজামতের পূর্বদিকের তোরণদ্বার। তোরণের ভগ্ন অংশ ও দরজার বিশাল কব্জা ছাড়া কিছু নেই। স্থানীয়রা এটিকে রণকব্জা বলেন। এই এলাকায় এমন অনেকগুলি দরজাবিহীন শুধু কব্জাটি দেখা যায়। এর কাছেই রাস্তার ধারের গেটটি কুরতাখানার গেট, এখানে দর্জিদের বাস ছিল। মজার কথা কুরতাখানা এখন লোকমুখে কুত্তাখানায় পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চলে ছিল বিখ্যাত চকবাজার বা চাঁদনি চক। এখানে হিরে, জহরত, সোনা, চাঁদি প্রভৃতি দামি জিনিস কেনাবেচা হত।
চকবাজারেই রয়েছে মণি বেগমের তৈরি চক মসজিদ। মীরজাফর আলি খানের দ্বিতীয় পত্নী ছিলেন মণি বেগম।
–চলুন, একটু চা খাওয়া যাক, গোপালদা বললেন।
–হ্যাঁ চলুন।
চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আড্ডাটা বেশ জমে উঠল। এখানেই ছিল চাঁদনি চক, এখন শুধুই চা-চক।
এই মসজিদের ভিতরে একটি সমাধি আছে, কার জানেন?
–না, এটা জানি না তো।
–সমাধিটা হল বিখ্যাত বীণাবাদক ওয়াজিদ খানের।
–আমাদের বাংলায় এমন বিখ্যাত বীণাবাদক ছিলেন, যাঁর জন্য বেগম সাহেবা মসজিদে সমাধিস্থ করালেন!
–একটু পিছিয়ে আপনাকে গল্প বলতে হবে। নবাব দরবারে মাঝেমধ্যেই নাচগানের আসর বসত। একবার লখনউ থেকে একটি নাচের দলের সঙ্গে নবাব দরবারে এলেন নর্তকী মণি। মীরজাফর এনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন এই মণি বেগমকে। মণি বেগম তাঁর অভিভাবকস্বরূপ তাঁর বীণাবাদককে রেখে দেন।
–আচ্ছা ইংরেজদের সঙ্গে যে বেগমের ভাল সম্পর্ক ছিল, ইনিই কি সেই!
–একদম ঠিক দাদা। পলাশির যুদ্ধের পরে মিরজাফর নবাব হলে বেগমের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়ে যায়, মিরজাফর মারা যাওয়ার পর পরবর্তী নবাব নির্বাচনেও মণি বেগমের হাত থাকত। নবাবদের মাসোহারা ছাড়া ইংরেজদের থেকে আলাদা মাসোহারা পেতেন এই বেগম। খুব ভাল সম্পর্ক ছিল ইংরেজদের সঙ্গে।
–একটা কথা কী মনে হয় জানেন দাদা, ইতিহাস আর মানুষের চরিত্র এক সরলরেখায় থাকে না। কত যে বাঁক নেয় মানুষ নিজেই জানে না। যে মিরজাফর আলি ইতিহাসের কুখ্যাত খলনায়ক, তাঁর পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মরা কিন্তু অন্যরকম জীবন কাটিয়েছেন। মুর্শিদাবাদের অন্যতম স্কুল নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন মণি বেগমের জমানো টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
–চলুন হাঁটি, হাঁটতে হাঁটতে আরও গল্প হবে।
–জানেন এই চকবাজার এলাকাতেই ছিল মুর্শিদাবাদের প্রথম প্রাসাদ। মুর্শিদকুলি খাঁ এখানেই তৈরি করেছিলেন চেহেলসেতুন প্রাসাদ। চল্লিশটি স্তম্ভ যুক্ত এই প্রাসাদটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল, বর্তমানে কোনও চিহ্নই আর নেই।
একটু এগোতেই রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকে চলে গেছে সিরাজউদ্দৌল্লা রোড, এই পথে গেলে আস্তাবল ও হাতিশালা দেখা যাবে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে নবাব বাহাদুর রোড ধরে সাউথ গেটের দিকে চললাম।
কিছুটা হাঁটার পর একটি ভাঙা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে গোপালদা বললেন, এটি আম্বাখানা মানে আমখানা।
–শুধু গ্রীষ্মকালে আম থাকবে বলে এত বড় বাড়ি, নবাবি বলে কথা।
–না দাদা, শুধু গ্রীষ্ম নয়, সারাবছর আম খেতেন নবাবরা। গোপালদা বলতে থাকেন–- মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সব নবাব আমের কদর করতেন, প্রায় ৩০০ রকমের আম পাওয়া যেত এখানে। কোহেতুর, নবাব পসন্দ, বেগম পসন্দ, চন্দনকোষা, সাদুল্লা (হিমসাগর), অমৃতভোগ, কিসনভোগ, চম্পা, সবুজা, ল্যাংড়া, আনসাস প্রভৃতি আম এখানে সংরক্ষণ হত। দিল্লির দরবারেও যেত মুর্শিদাবাদের আম। এখানে বিশাল বিশাল জালায় ঘি অথবা মধু ভর্তি করে, আমের বোঁটায় মোম লাগিয়ে এই জালায় আম থাকত। এতে একবছর আম ভাল থাকত। এ সব কাজ যাঁরা করতেন, তাঁদের আমতারাশ বলা হত। আম মুর্শিদাবাদে নবাবিয়ানা ছিল খুব আদরের।
সবচেয়ে মজার কথা কী জানেন-– মিরজাফরের ছেলে মিরনকে আমরা সবাই জানি সিরাজের ঘাতক হিসাবে। এই মিরনের আমের প্রতি ভালবাসা ছিল সবচেয়ে বেশি। মুর্শিদাবাদে মিরজাফরের পর তিনি নবাবি পদের মোহও ত্যাগ করেছিলেন আমের জন্য।
আবার হাঁটা শুরু। অনেক প্রাচীন বাড়ি, দেওয়াল পেরিয়ে আমরা হাঁটছি। একটি সুদৃশ্য মসজিদ দেখিয়ে গোপালদা বললেন– এটি সরাইখানা মসজিদ।
হাঁটতে হাঁটতে সাউথ গেটের কাছে এক গলির মধ্যে একটি ভাঙা বাড়ি দেখিয়ে বললেন– এটি পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইসকন্দর আলি মির্জার ভিটে।
সাউথ গেটের সামনে দিয়ে আবার নবাবি এলাকার মধ্যে প্রবেশ করলাম। গোপালদা বলে চলেছেন– এই তোরণদ্বারে আগে রক্ষী থাকত, নহবত বাজত, তা আজ অতীত। গেট দিয়ে প্রবেশ করে ডানদিকের এই সাধারণ বাড়িতে নবাবদের বর্তমান বংশধরেরা থাকেন। পাশে এই ঘণ্টা-পিলারটি অনেক পুরনো, এর পিছনে সেনানিবাস ছিল। কয়েক-পা এগিয়ে বামদিকে দেখালেন দারার আলি খাঁ এস্টেট ও ছোট ইমামবাড়া। এখনও এখান থেকে মহরমের সময় শোভাযাত্রা করে বড় ইমামবাড়ায় যায়।
পায়ে-পায়ে নদীর ধারের দিকে এগিয়ে যাই। এখানেই নবাবরা বিচরণ করতেন। তাঁদেরই নদীর ধারে বসার জায়গা হাওয়াখানা। এর কাছেই সুন্দর তিন গম্বুজবিশিষ্ট সফেদা মসজিদ। এখানে নদীর ধারটি সুন্দর করে সাজানো। রাস্তার দু’ধারে রয়েছে চিলথাম, কালো পাথরের দু’টি স্তম্ভের উপর দু’টি উড়ন্ত পাখি, ডানদিকে প্রাচীন বড় বড় বাড়ি।
গোপালদা বলে চলেছেন-– এই অঞ্চলে ছিল আলিবর্দির প্রাসাদ, সব কিছু ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছোটবেলা থেকে সিরাজ এখানেই বড় হয়েছেন। নবাব হওয়ার পর সিরাজ নদীর ওপারে হীরাঝিল প্রাসাদে থাকতেন। আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপ।
একটু এগিয়ে সুদৃশ্য বড় বাড়ি দেখিয়ে বললেন এটাই নবাবদের তৈরি শেষ প্রাসাদ বা নতুন রাজবাড়ি, নবাব ওয়াশিফ আলি মির্জার ওয়াশিফ মঞ্জিল। বাইরে থেকে দেখে সাধ মেটান। মঞ্জিলের সামনে নদীর ধারে বিরাট হাওয়াখানা, যা আগে নবাবদের একান্ত ছিল, আজ তা সর্বসাধারণের। এখানে বসে একটু পুরনো স্বাদ উপভোগ করুন।
হাওয়াখানার সামনে একটি বেমানান জেটিঘাট। এখানে নানান বোট, লঞ্চ নোঙর করে। নদী পারাপার হয়। এর পাশের ঘাট থেকে নৌকাভ্রমণে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায়।
ওয়াশিফ মঞ্জিলের পাশের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলেন রানিমহল, মীনা মহল, সোনামহলে। এখন বেহাল অবস্থায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একসময় কী জমজমাট ছিল এই এলাকা। এর সামনে দিয়ে হাঁটলে দেখা যাবে নবাব ওয়াশিফ মির্জার সাধের পাহাড় বাগান। অতীতে এখানে কৃত্রিম পাহাড়, নানান ফুলের গাছ ও নানান মূর্তি দিয়ে সাজানো ছিল। মূর্তিগুলি হাজারদুয়ারিতে স্থানান্তরিত হয়েছে আর বাকি বাগানটি হতশ্রী অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
এই রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে আমরা হাজারদুয়ারির দক্ষিণদিকের দরজার সামনে এলাম। এখানেই রয়েছে একটি সূর্যঘড়ি। এখান থেকে বাঁদিকে গেলে দোকানপত্তরে ভর্তি হয়ে গেছে।
–আজ আর নয় গোপালদা, একটু হজম করি এগুলো।
–আবার আসবেন দাদা। গোপালদা চলে গেলেন।
ব্রিজ ঘাটের তলা দিয়ে গঙ্গার ধারে এসে বসেছি। বাংলাভাষার চেয়ে বাংলার ইতিহাসের আরও করুণ অবস্থা। সেটা মালুম পাচ্ছি। নদীর ওপারে পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন সূর্য ডুবেছিল এখানেই। স্বাধীনতার পর আবার যে সূর্য উঠল, তা এত মলিন কেন? মেঘ, কুয়াশা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে ভারত ইতিহাসের আবার কি কোনও পরিবর্তন হতে চলেছে।
-সংগৃহীত