বাংলা কবিগানের অন্যতম রূপকার হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন রমেশ শীল (Ramesh Shil)। বাংলা কবিগানের ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সমাজ চেতনার প্রথম সার্থক মেলবন্ধন ঘটেছিল তাঁর হাতেই। রমেশ শীল সুফী গানের অন্যতম ধারা মাইজভান্ডারী গানের অন্যতম কিংবদন্তিসম গায়ক ও সাধক ছিলেন। কেবলমাত্র লোকায়ত শিল্পী হিসেবেই নয় তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর যে শাসক বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়াও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও তিনি নিজের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
১৮৭৭ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানার অন্তর্গত গোমদন্ডী গ্রামে কবিয়াল রমেশ শীলের জন্ম হয়। তাঁর পিতা চন্ডীচরণ শীল ছিলেন পেশাতে নাপিত ও কবিরাজ। তাঁর মায়ের নাম রাজকুমারী শীল। রমেশ শীল চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াকালীন তাঁর পিতার মৃত্যু হলে সেখানেই তাঁর পড়াশোনার ইতি ঘটে এবং সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর এক লেখায় নিজে লিখেছেন – ‘আমিই বালক, চালক,পালক, আমার আর কেহ নাই।/ মায়ের অলংকার সম্বল আমারা বিক্রি করে খাই।’ অপূর্ব মোহিনীর সাথে ১৯০০ সালে রমেশ শীলের বিয়ে হয়। তাঁদের মেয়ের নাম ছিল শৈলবালা। পরবর্তীকালে রমেশ শীল অবলা বালা নামে জনৈক মহিলাকে বিয়ে করেন।
সংসার চালাতে এরপর তিনি নাপিত ও কবিরাজী করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে রমেশ শীল অধুনা মায়ানমারের রেঙ্গুন শহরে যান ও সেখানে একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি একটি দোকানেরও মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু দেশকে ভালবেসে পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি নিজের গ্রামে ফিরে এসে আবার কবিরাজি শুরু করেন। এই সময়েই মূলত তিনি কবিগানের প্রতি ভীষণ ভাবে অনুরক্ত হয়ে উঠেন।
১৮৯৭ সালে মঞ্চে প্রথম কবিগান পরিবেশন করেন রমেশ শীল। এরপর ১৮৯৯ সালে কবিগানের লড়াইয়ে তিনজন কবিয়ালকে পরাজিত করার পুরস্কার স্বরূপ উদ্যোক্তা ও দর্শকদের কাছ থেকে মোট তেরো টাকা সম্মানী লাভ করেন তিনি যা পেশা হিসাবে কবিগানকে বেছে নিতে রমেশ শীলকে অনুপ্রাণিত করে। বাংলা কবিগানের ইতিহাসে ‘রমেশ উদ্বোধন কবি সংঘ’ নামে প্রথম সমিতি গঠিত হয় রমেশ শীলের উদ্যোগে ১৯৩৮ সালে। অশ্লীলতা মুক্ত কবিগান ছিল এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য। রমেশ শীল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ১৯৪৪ সালে। ১৯৪৮ সালে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে তিনি সম্বর্ধিত হন ‘বঙ্গের শ্রেষ্ঠতম কবিয়াল’ উপাধিতে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার যাওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে রমেশ শীলও গ্রেফতার হন ও তাঁর ‘ভোট রহস্য’ পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে সরকার। কবি দীর্ঘ্যদিন কারাভোগ করেন এসময়। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করার কারণে রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয় যে কারণে শেষ জীবনে তিনি নিদারুণ অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হন।
রমেশ শীলের প্রথম দিককার গানগুলি পুরাণ ও কিংবদন্তী নির্ভর ছিল। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্রবলভাবে সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। কবিগানের বিষয়বস্তুতে আসে আমুল পরিবর্তন। যুদ্ধ-শান্তি, চাষী-মজুদদার, স্বৈরতন্ত্র-গণতন্ত্র তাঁর কবিগানের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের মাঝিরঘাটে দুর্গাপূজায় কবিগানের আসর বসে। প্রায় হাজার পঞ্চাশেক মানুষের উপস্থিতিতে কবিগান শুরু হয়। প্রধান কবিয়াল ছিলেন তৎকালীন জনপ্রিয় কবিয়াল মোহনবাঁশী ও চিন্তাহরণ। গানের আসরে চিন্তাহরণ অসুস্থ হয়ে পড়লে আয়োজকরা কবিয়াল দীনবন্ধু মিত্রকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু দীনবন্ধু মিত্র তাঁর জায়গায় রমেশ শীলকে মঞ্চে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলে কোমরে চাঁদর পেঁচিয়ে মঞ্চে ওঠেন রমেশ শীল। মাত্র একুশ বছরের যুবক রমেশ শীলকে মোহনবাঁশি অবজ্ঞা করে বলেছিলেন , “এই পুঁচকের সাথে কি পালা করা যায় ?” প্রত্যুত্তরে রমেশ শীল বলেছিলেন “উৎসব আর ভয় লজ্জা কম নয়।/কে বা হারাতে পারে কারে।/পুঁচকে ছেলে সত্যি মানি শিশু ব্রজ ছিল জ্ঞানী/চেনাজানা হোক না আসরে।” জীবনের প্রথম আসরে টানা আট ঘণ্টা গেয়েছিলেন কবিগান। কবিগানের ঐ লড়াইয়ে কোনপক্ষই কাউকে হারাতে পারেনি। আয়োজকদের হস্তক্ষেপে কবিগান বন্ধ হয় সেদিনের মত। তবে তখন থেকেই রমেশ শীলের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ।
রমেশ শীলের প্রধান লক্ষ্যই ছিল কবিগানের ভাষা ও পরিবেশনা থেকে অশ্লীলতা বিসর্জন। রমেশ শীলের উপস্থাপন ও মার্জিত শব্দচয়ন কবিগানে রুচিশীলতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। দেশাত্মবোধ, দুর্ভিক্ষ- মন্বন্তর, ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলন তার গানের ভাষায় উঠে এসেছে জোরালো ভাবে। তাঁর দেশাত্মবোধ ছিল সুগভীর। তাই তো তিনি লিখেছেন – ‘বাংলার জন্য জীবন গেলে হব স্বর্গবাসি/ আমার বাংলার দাবি ঠিক থাকিবে যদিও হয় ফাঁসি’।
১৯৫৪ সালে জণগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নুরুল আমিনকে পূর্ববাংলার গভর্নর বানানো হয়। নুরুল আমীন চট্টগ্রামে এলে জনগণের কাছে লাঞ্চিত হলে রমেশ শীল এই নিয়ে একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনা করেন।
“শোন ভাই আজগুবি খবর
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর।
দিনের তিনটা বেজে গেল পল্টনে সভা বসিল
হায় কি দেখিলাম কি ঘটিল।
মানুষ ভয়ে জড়সড়
হঠাৎ দেখি পচা আণ্ডা
মন্ত্রীকে করিতেছে ঠাণ্ডা।
উড়তে লাগলো কাল ঝাণ্ডা,
মন্ত্রীর চোখের উপর।
বিপ্লবী চট্টগ্রাম গেলা সূর্যসেনের প্রধান কেল্লা
মন্ত্রী করে তৌব্বা তিল্লা,
করবো না জনমভরে চট্টগ্রাম শহর।”
গানটি সে সময়ে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল এবং এর জন্য তাঁকে কারাবরণও করতে হয়। এই সময়ে তাঁকে টাকার লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত লেখার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেন। তাঁকে দেখানো এই প্রলোভনের জবাব দিয়ে তিনি লিখেছিলেন –
“আমার খুনে যারা করেছে মিনার
রক্তমাংস খেয়ে করেছে কঙ্কালসার
আজ সেই সময় নাই ত্বরা ছুটে আসো ভাই
বেদনা প্রতিকারের সময় এসেছে।”
রমেশ শীল রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘আশেকমালা’, ‘শান্তিভান্ডার’, ‘নুরে দুনিয়া’, ‘দেশের গান’, ‘ভোট রহস্য’, ‘চট্টল পরিচয়’, ‘ভান্ডারে মওলা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রমেশ শীল বেদুঈন ছদ্মনামে “বদলতি জমানা” এবং ঋষিভট্ট ছদ্মনামে “ভণ্ড সাধুর” কবিতা নামে দু’টি বই লিখেছিলেন। রমেশ শীল তাঁর সমগ্র কবি জীবনে প্রায় সাড়ে তিনশোর বেশি মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেন যার বেশিরভাগই মাইজভাণ্ডারী ধারার প্রবর্তক আহমেদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীকে উদ্দেশ্য করে।
রমেশ শীল তাঁর সারাজীবনের কাজের জন্য অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। সম্প্রতি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।
১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল রমেশ শীলের মৃত্যু হয়।