Home পরিবেশ শীত পড়লেই সিকিমের আকাশে ওড়ে অপরাজিতা

শীত পড়লেই সিকিমের আকাশে ওড়ে অপরাজিতা

ছবি সংগৃহীত

দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন গাছজুড়ে থোকা থোকা অপরাজিতা ফুটে আছে। কাছে গিয়ে না দেখলে ভুল ভাঙাই মুশকিল। ফুল নয়, গাছ আলো করে বসে আছে আশ্চর্য নীল রঙের পাখির ঝাঁক। দুটো দশটা নয়, হাজারে হাজারে পাখি। আকাশ থেকে উড়ে এসে কখনও বসছে মাটিতে, পাথরে, কখনও বা ন্যাড়া গাছের ডালে। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। আর সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতেই প্রত্যেক শীতে পর্যটক আর পক্ষীপ্রেমীদের ঢল নামে সিকিমে।পাখির নাম গ্রান্ডালা। হিমালয়ের পাখি। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশ, মানে চিনের তিব্বত, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার আর ভারতের কিছু অংশে ঠান্ডা পাহাড়ি এলাকায় গিরিবর্ত্মে বা ঘন পাইনের জঙ্গলে দেখা মেলে এ পাখির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অরুণাচল প্রদেশের সেলা পাস বা সেলা সরোবরের আশেপাশে প্রায়শই চোখে পড়ে ৪০০ বা ৬০০ সদস্যের গ্রান্ডালা পরিবারের৷পুরুষ গ্রান্ডালা পাখির গায়ের রং নিখাদ ঘন নীল। ছোট্ট ডানাজোড়ায় গভীর কালো রঙের পোচ। ছোট্ট লেজেও অল্প কালোর ছোপ। স্ত্রী পাখির গায়ে আবার নীলের চিহ্নমাত্রও নেই। পুরুষ পাখির থেকে আকারে সামান্য ছোট এই স্ত্রী পাখিদের গায়ের রঙ কখনও বাদামি, কখনও সাদার ছিট দেওয়া ধূসর খয়েরি। কিছুটা আমাদের দেশি ময়না বা শালিখের আকারের হলেও এদের গড়ন, ডানার চরিত্র অনেকটাই আলাদা।

পুরুষ ও নারী গ্রান্ডালা

সেলাপাসের তাপমাত্রা -১০ ডিগ্রির নীচে নেমে যায় শীতকালে। বরফ শীতল হাওয়া বিঁধে যায় ছুরির মতো। খাবারের অভাব, বরফঝড়, সব মিলিয়ে সেই পরিবেশ গ্রান্ডালার মতো ছোট পাখিদের বেঁচে থাকার জন্য খুবই প্রতিকূল। তাই শীত পড়তেই ঘরবাড়ি ছেড়ে দলে দলে উড়ান দেয় তারা। নেমে আসে ৯৫০০ ফুট উচ্চতায় উত্তর সিকিমের লাচেন আর তার আশেপাশের অঞ্চলে।

লাচেনের আকাশ পাহাড়, গুরুদোংমার লেক

এই সময় সিকিমের উত্তরপ্রান্তের জনপদগুলোর আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা মেলে গ্রান্ডালা পাখির। জীবন্ত ফুলের গুচ্ছের মতো কখনও তারা বসে থাকে ঝোপেঝাড়ে, গাছের মাথায়। আকাশ থেকে কখনও বা ঝাঁক বেঁধে একপশলা নীল বৃষ্টির মতো নেমে আসে নীচের দিকে। সালিম আলি তাঁর বিখ্যাত বইতে গ্রান্ডালা পাখির ছটফটে ঝাঁকের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা যেন ছত্রে ছত্রে মিলে যায় আজও।

অরুণাচলের সেকা লেক

সোনালি হলুদ রঙের ছোটো ছোটো বাকথর্ন ফল গ্রান্ডালা পাখিদের প্রিয় খাবার।  সিকিমের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষত লাচেন ও তার আশেপাশের দুষণমুক্ত পরিবেশে প্রচুর জন্মায় এই বাকথর্ন গাছ। ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে ফল আসে গাছে। নামে সাগর বাথথর্ন না সি-বাকথর্ন হলেও হিমালয় অঞ্চলের তীব্র ঠান্ডা এবং শুকনো মাটিতেই জন্মায় এই ফলের গাছ। নানারকম ভিটামিন আর অ্যামিনো অ্যাসিডে ভরা এই ফল গ্রান্ডালার বিশেষ পছন্দের। তাই শীতকালে ফলাহারের লোভেও দল বেঁধে পাড়ি দেয় তারা। ভূটান পেরিয়ে নেমে আসে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দূরের লাচেনে।

সোনালি হলুদ বাকথর্ন ফল বড় প্রিয় গ্রান্ডালার

শীতকালে লাচেনের তাপমাত্রা ঘোরে ৫ থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে। বাঙালির হিসেবে একেবারে হাড়কাপানো শীত। কিন্তু ঠান্ডার ভয়ে এডভেঞ্চার কি আর থমকে থাকে! আর তাই হাড়হিম শীত, তুষারপাত আর খারাপ আবহাওয়ার চোখরাঙানি উপেক্ষা করেও প্রতিবছর এইসময়টায় গ্রান্ডালার টানে লাচেন ছোটেন বেশ কিছু মানুষ। পক্ষীবিশারদ না হলেও ক্ষতি নেই। নিছক পাখিদের ওড়াউড়ি ফ্রেমবন্দি করতে ভালোবাসেন কি? উত্তর যদি হ্যাঁসূচক হয়, তাহলে নীলরঙা রূপসী গ্রান্ডালার খোঁজে আগামী শীতে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে আপনিও পাড়ি দিতে পারেন উত্তর সিকিমে।

কীভাবে যাবেন- কলকাতা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার একাধিক ট্রেন আছে। হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেল, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস, তিস্তা-তোর্সা, কাঞ্চনকন্যা বা উত্তরবঙ্গগামী যেকোনও ট্রেনে নামবেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে সরাসরি চলে যেতে পারেন লাচেন। অনেকে আবার গ্যাংটক হয়েও লাচেন যান। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লাচেনের দূরত্ব প্রায় ১৯৫ কিলোমিটার। আর লাচেন থেকে গ্যাংটকের দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।