শহীদনূর আহমেদ, সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে শুঁটকি প্রস্তুতের ধুম পড়েছে। জেলার বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় ও বিলে কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ধরা পড়ে পুঁটি, টেংরা শোলসহ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ। কোনো ধরনের রাসায়নিক ছাড়া দেশীয় এসব মাছ শুকিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে শুটকি। উৎপাদিত শুটকি রাজধানী ঢাকাসহ রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যে।
জেলার ১২ উপজেলার বিভিন্ন হাওরের অস্থায়ীভাবে গড়ে উঠা শতাধিক মাচাং (শুটকি পল্লী) এ উৎপাদন করা হয় এই শুটকি। প্রাকৃতিক জলাশয়, বিল ডোবা থেকে আহরণ করা মাছ এই মাচাংয়ে বিক্রি করেন জেলেরা। তাছাড়া বিভিন্ন গ্রামীণ বাজার থেকে মাছ কিনে নিয়ে আসেন শুটকি উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে এই মাছ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কেটে মাচাং এ শুকিয়ে শুটকিতে রূপান্তর করা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্ষা মওসুমের শেষ দিকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে মাঁচা তৈরী করে শুটকি উৎপাদন করেন জেলেরা। জেলার ১২ উপজেলায় শতাধিক শুটকি পল্লীতে অন্তত ১০ থেকে-১২ প্রজাতির শুটকি উৎপাদন হয়ে থাকে। এবছর শুটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫০০ মেট্টিক টন। যা ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলায় বছরে উৎপাদিত শুটকির আর্থিক মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত দেশীয় মাছের শুটকির রয়েছে দেশ বিদেশে কদর। এখানকার শুটকির মান ও স্বাদ ভালো হওয়ায় বিদেশের বাজারেও প্রশংসিত হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ আমেরিকা, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ। শুটকি উৎপাদনের সাথে জেলার কয়েক হাজার জেলে যুক্ত রয়েছেন বলে জানান তারা।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কবির গত ৪ বছর ধরে শুটকি পল্লীতে কাজ করেন। এই পেশায় কাজ করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেন এই জেলে। তার মতো এলাকার কয়েকটি শুটকী পল্লীতে অনেকেই কাজ করেন।
কবির বলেন ‘আমরা হাওর থেকে মাছ কিনে আনি। এই মাছগুলো মহিলাদের দিয়ে কাটাছেঁড়া করি। ধুয়ে লবণ দিয়ে রেখে রোদে শুকিয়ে শুটকি করি। পরে সেগুলো বাছাই করে বস্তায় বন্দী করে রাখি। প্রতি মঙ্গলবার মহাজন কিশোরগঞ্জ নিয়ে এই শুটকি বিক্রি করেন। আমাদের শুটকিতে কোনো ক্যামিকেল ব্যবহার হয়না। তাই এর স্বাদ অন্যরকম। বাজারে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এই শুটকির। এ বছরে আমাদের মাঁচা থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার শুটকি বিক্রি করা হয়েছে।’
দেখার হাওরের কাইক্কারপাড় গ্রামের শুটকি পল্লীর মালিক সুরুজ আলী বলেন, শুটকি ব্যবসার সাথে প্রায় ৩২ বছর ধরে রয়েছেন। হাওরের শুটকির কদর দিন দিন বাড়ছে। দেশে যেমন এর চাহিদা রয়েছে তেমনি বিদেশেও এই শুটকির চাহিদা রয়েছে। প্রকারভেদে মন প্রতি শুটকি ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এই অঞ্চলের শুটকি ব্যবসার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
শুটকির গুণাগুণ রক্ষায় প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার তৈরীতে মৎস্য বিভাগ কাজ করছে বলে জানিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামশুল করিম বলেন, এখানকার শুটকি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী করা হয়। এই অঞ্চলের শুটকির আন্তর্জাতিক বাজার রয়েছে। এই শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে শুটকি উৎপাদনে মৎস্য বিভাগ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। শুটকিকে ব্রেন্ডিং হিসেবে তুলে ধরতে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।