সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্য়ায়
কলকাতা : তিন দশক আগে হর্ষদ মেহতার শেয়ার বাজারে কেলঙ্কারি এখনও প্রাসঙ্গিক । তাই সেই ঘটনার আদলে সম্প্রতি ওয়েব সিরিজ কিংবা ছবিও করতে দেখা যাচ্ছে । শেয়ার কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন হর্ষদ। যারফলে গত শতাব্দীর ৯০ এর দশকে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ৷ সুটকেসে করে এক কোটি টাকা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন ১৯৯২ শেয়ার কেলেঙ্কারির খলনায়ক হর্ষদ মেহতা৷ গ্রেফতার হওয়ার পর তিন মাস জেলে থাকার পর সেই বছরের ৯ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি৷ তার কিছুদিন পরেই আইনজীবী রাম জেঠমালানিকে সঙ্গে নিয়ে একেবারে সাংবাদিক বৈঠক করেন৷ সেই বৈঠকেই ফাটিয়েছিলেন এমন ঘুষ কাণ্ডের বোমা৷
কেউ ভাবতেও পারেনি হর্ষদের মতো এক নিতান্ত নিরীহ গুজরাতি-জৈন পরিবারে জন্মানো ছেলেটি একদিন হয়ে উঠবে ‘সুলতান অফ দালাল স্ট্রিট’৷ হর্ষদ মেহতা প্রথম জীবনে নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্স কোম্পানিতে কাজ করলেও তা ছেড়ে চলে আসেন বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে৷ সেখানে ব্রোকার পি অম্বালালের অফিসে ‘জবার’ হিসেবে কাজ করতে করতে কিছুদিনের মধ্যেই বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার হয়ে ওঠেন৷ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে খুলে ফেলেন গ্রো মোর রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। গত শতাব্দীর ৯০ দশকের শুরুতে তার হাত ধরে যেভাবে শেয়ার বাজারে ‘বুল রান’ হয়েছিল তাতেই তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় শেয়ার বাজারের ‘সুপারস্টার’৷
হর্ষদ ওই সময় হঠাৎ প্রচুর পরিমাণে ‘ অ্যাসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানিস’ বা ‘এসিসি’-র শেয়ার কিনতে থাকায় চড়চড় করে বাড়তে থাকে ওই শেয়ারের দাম৷ বছর দেড়েক মতো সময়ে প্রতিটি শেয়ারের দাম দুশো টাকা থেকে প্রায় ন’হাজার টাকায় পৌঁছে যায় অর্থাৎ বৃদ্ধি প্রায় ৪৪৪০ শতাংশ(%) ৷ এসিসি-র পাশাপাশি শেয়ার সূচকেরও উত্থান ঘটেছিল৷ ফলে ওই সময়ে নামী অনামী বহু কোম্পানিরই শেয়ারের দাম অকারণেই বেড়ে গিয়েছিল একেবারে উল্কার গতিতে ৷ এমন বুল রানে বদলে গিয়েছিল হর্ষদের জীবন যাত্রার মান৷ বম্বের ওরলিতে প্রাসাদোপম বাড়ির সামনে সার দিয়ে দাড়িয়ে থাকত বিলাসবহুল গাড়ি ৷ তার কদর বেড়ে যায় ভিআইপিদের কাছেও ৷ যে কোনও সংস্থাই তাদের শেয়ার ইস্যু বাজারে হিট করাতে হর্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইত ৷
সেই সময়টা আজকের মতো ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টের যুগ নয় ৷ তখন স্টক এক্সচেঞ্জের হলে শেয়ারের নাম আর দাম ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে চলত কেনা বেচা৷ সেই সময় রেডি ফরোয়ার্ড ডিল নামে একটি প্রথা ছিল । যার ফলে দুটি ব্যাংকের মধ্যে স্বল্প সময়ের (১৫ দিন) লেনদেনের সাপেক্ষে একটি চুক্তি হত। সেক্ষেত্রে ব্রোকারদের কাজ ছিল দুটি ব্যাংকের মধ্যে সংযোগ রাখা ৷ এক্ষেত্রেও অর্থ কামানো সুযোগ নজরে এল হর্ষদের ৷
অনেক ব্যাংক সপ্তাহের প্রথম দিনে বন্ড বিক্রি করে সেই টাকা অন্যত্র বিনিয়োগ করত এবং স্ট্যাটুইটারি লিকুইডিটি রেশিও ঠিক রাখতে সপ্তাহ শেষে সেটাই ‘বাই-ব্যাক’করে নিত। এটা করতে ‘রেডি ফরোয়ার্ড ডিল’ ছাড়া উপায় নেই৷ মেহতারা তখন রীতিমতো আস্থা অর্জন করে ব্যাংকগুলিকে জানালেন, যেহেতু প্রচুর ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন চলছে তাই ওই সময় বলা সম্ভব নয় যে ঠিক কোন ব্যাংকের সঙ্গে শেষমেশ চুক্তি হচ্ছে তাই চেকে কোনও ব্যাংকের নামের বদলে হর্ষদ মেহতার নাম যেন লেখা হয়৷ যা কিন্তু ছিল পুরোপুরি বেআইনি৷
এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জালিয়াতি শুরু করলেন হর্ষদ মেহতা । শেয়ার বাজারে তখন কোনও ব্যাংক বিনিয়োগ করতে পারত না কিন্তু পরোক্ষ ভাবে এই পথেই ব্যাংকের টাকা ঢুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিয়েছিল শেয়ারবাজারকে৷ তাছাড়া তখন শেয়ারের পরিবর্তে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তবে সেই শেয়ার হস্তান্তর না করে বদলে ব্যাংক ইস্যু করতো ব্যাংক রিসিট (বি আর) ৷ এই বি আর ইস্যু করার মানেই ওই শেয়ার বেচা যাবে না যতক্ষণ পরিবর্তে নেওয়া টাকা শোধ হচ্ছে৷ হর্ষদ লক্ষ্য করলেন জাল বিআর ইস্যু করছে ব্যাংক অফ করাদ এবং মেট্রোপলিটন কো-অপারেটিভ ব্যাংক৷ ফলে এই দুই ব্যাংকে তিনি কাজে লাগালেন যাতে এরা তাঁর নামে চেক কেটে দেয় এবং তখন আপাতত এই জাল বিআর দিয়ে আশ্বস্ত করতে লাগলেন৷
হর্ষদ মেহতা এবং তার সঙ্গীরা মিলে অনৈতিক ভাবে শেয়ার বাজারে ‘বুল রান’করেছেন সেটাই প্রথম ফাঁস করেন ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল সাংবাদিক সুচেতা দালাল৷ তাঁর প্রতিবেদনে উঠে আসে কীভাবে ব্যাংকগুলিকে শেয়ার বাজারের লেনদেনে যুক্ত করে তিনি পকেটে পুরছেন বেশ কিছু টাকা। এর পরেই পতনের শুরু শেয়ার বাজার এবং হর্ষদ উভয়েরই।
দেখা গেল, তখন অনেকেই সচেতন হয়ে নড়ে চড়ে বসলেন, শেয়ার বাজারও ধাক্কা খেল। অবস্থা বেগতিক দেখে হর্ষদ নিজেকে গুটিয়ে নিতে গা ঢাকা দেন৷ কিছুদিনের মধ্যে সিবিআই তাঁকে ও তাঁর ভাইকে গ্রেফতার করে৷ অভিযোগ ছিল ৯০টি কোম্পানির ২৮লক্ষ শেয়ার যার মূল্য ২.৫ বিলিয়ন টাকা তিনি তছরুপ করেছেন ৷ এর কিছুদিন পরে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেন৷ আর তখনই হর্ষদ মেহতার শেয়ার কেলেঙ্কারি এক অন্যমাত্রা পায় ৷হর্ষদ মেহতার দাবি ছিল, কংগ্রেসকে অনুদান হিসেবে সুটকেসে ভরে এক কোটি টাকা দেওয়া হয়৷ সাংবাদিক বৈঠকে সেদিন সঙ্গে এনেছিলেন অনুরূপ একটি বড় সুটকেস৷ যথারীতি সেই টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন নরসিমা রাও৷ যদিও পরে সিবিআই তদন্তে উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি এই ঘুষ দেওয়ার দাবির স্বপক্ষে৷ যথাযথ প্রমাণের অভাব হলেও সেদিনকার বিগ বুলের নাটকীয় বিবৃতি ঘিরে একটা অজানা রহস্য যেন আজও থেকে গিয়েছে৷
হর্ষদ নিজেকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী নাম জড়িয়ে নিছক ফাঁকা আওয়াজ দিয়েছিলেন না কি ক্রোনি ক্যাপিটালিজম(ব্যবসায় সাফল্যের জন্য সরকারের সঙ্গে খাতির ও দহরম-মহরম)-এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ ছিল সেটি ৷ তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা শক্ত ৷ তবে দেশজুড়ে বিতর্কের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে একটা প্রশ্ন অবশ্যই উঠেছিল সেদিন৷ সেই সময় হর্ষদ ছুড়ে দিয়েছিলেন একটা কথা – বেছে নিতে হবে হর্ষদ মেহতা না পিভি নরসিমা রাও কে বিশ্বাসযোগ্য? হর্ষদ তার হলফনামায় প্রমাণস্বরূপ এবং পরবর্তী বিবৃতিতে বিশদে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কেন, কীভাবে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল নরসিমা রাওয়ের কাছে ৷ যদিও ওই দিন ৭ রেসকোর্স রোডে প্রধান সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম করেছিলেন তারা এই ঘটনার কথা অস্বীকার করেন অথবা মারা গিয়েছেন৷
দিল্লি পুলিস ও অন্যান্য সূত্রে থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, হর্ষদ যখন ওই টাকা দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন ওই সময় প্রধানমন্ত্রী আদৌ রেসকোর্স রোডে বাসভবনে ছিলেন না৷ তিনি ছিলেন সাউথ ব্লক কার্যালয়ে৷ তাছাড়া হর্ষদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা নিয়ে বেশ কিছু প্রামাণ্য পেশ করলেও ধোঁয়াশা থেকে যায় ১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর তাঁর সঙ্গে রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হওয়ার বিষয়টি ৷ পাশাপাশি অপর আইনজীবী তথা রাম জেঠমালানির ছেলে মহেশ প্রমাণস্বরূপ অডিও টেপে রেকর্ড করা কথাবার্তা শুনিয়েছিলেন৷ ১৯৯৩ সালের ২৮জুন প্রথম টেপ রেকর্ডারে কথাবার্তা ছাড়া হয় – যাতে রেকর্ড করা ছিল হর্ষদের সঙ্গে সতপাল মিত্তালের ছেলে শিল্পপতি সুনীল মিত্তালের টেলিফোনে কথাবার্তা৷ ওই টেপে হর্ষদ সুনীলকে বলেছিলেন রাওয়ের ব্যক্তিগত সহকারি আর কে খান্ডেকারের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং মনে করিয়ে দিতে ৪ নভেম্বর মিটিং এর ব্যবস্থা করার ব্যাপারে৷ সেখানে বলা হয়েছিল ৬৭ তখন দেওয়া হবে এবং বাকি ৩৩ পরে দেওয়া হবে৷ তবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে টাকা দেওয়ার কোনও কথা উল্লেখ ছিল না সেই কথোপকথনে৷ তবে এটা চূড়ান্ত প্রমাণ ধরা হয়নি কারণ আদালতে টেপে কথাবার্তা গ্রাহ্য নয় যেহেতু তা সহজে সম্পাদনা করা যায়৷
সেই সময় শাসক দল জানিয়েছিল, হর্ষদের উদ্দেশ্য ছিল – সময় কিনতে, নজর সরিয়ে দিতে ও দীর্ঘ হাজত বাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে এমন খেলা খেলেছিলেন যাতে রাওয়ের সরকার পড়ে যায় এবং তিনি লাভবান হন৷ তবে এক কোটি টাকা ভরা সুটকেস দেওয়ার বিষয়টি ঘিরে প্রশ্ন আজও রহস্যই থেকে গিয়েছে৷পরবর্তীকালে হর্ষদের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়েছিল৷ সেই সময় তিনি থানে জেলে ছিলেন এবং একদিন রাতে বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে থানে হাসপাতালে ভর্তি করা হন৷ সেখানেই ২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়৷