মাসুদুর রহমান রানা, বগুড়া থেকে : এবার ইরানী অপরাধী চক্রের সদস্যরা বগুড়ায় জাল ফেলেছে। ‘শয়তানের নি:শ্বাস’ (এক ধরণের মাদক) ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে এ চক্র।
এতোদিন বগুড়া শহরে এ চক্র সক্রিয় থাকলেও এখন তাদের নজর পড়েছে উপজেলাগুলোতেও। ইতোমধ্যে চক্রের ইরানী সদস্যরা শিবগঞ্জে একটি বিকাশের দোকান থেকে ‘শয়তানের নিশ্বাস’ ছড়িয়ে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে পুলিশ এই চক্রের সদস্য ইরানী দুই যুবককে গ্রেফতার করেছে।
জানা গেছে, শয়তানের নি:শ্বাস’ হলো এক ধরণের মাদক। যার নাম স্কোপোলামিন। প্রতারক চক্র যার নাম দিয়েছে ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নি:শ্বাস। এ মাদক মানুষের নি:শ্বাসে ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের ‘মাইন্ড কন্ট্রোল’ করে সর্বস্ব লুটে নেয় এ চক্র। যারা এ চক্রের খপ্পরে পড়ে তারা ‘সম্মোহিত’ হয়ে যান। এরপর স্বেচ্ছায় নিজের মূল্যবান জিনিসপত্র, সোনার গহনা ও টাকা তুলে দেন প্রতারকের হাতে।
ক’দিন আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে বগুড়ার শিবগঞ্জে। বিকাশের এক এজেন্টকে সম্মোহিত করে এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে ইরানী ও বাংলাদেশি অপরাধী চক্রের সদস্যরা। তবে পরে পুলিশ আজাদ নুবাহার (৩৫) ও আরশাদ আমান (৩৮) নামে চক্রের ইরানী দুই সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।
শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের হৃদয় টেলিকম দোকানের মালিক ও বিকাশ এজেন্ট দুলাল মিয়া জানান, গত ৪ আগস্ট ওই দুই ইরানী যুবকসহ স্থানীয় ৪-৫ জনের সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সদস্যরা তার প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। এরপর অডিট করার অজুহাতে মানিব্যাগ থেকে বিভিন্ন দেশের ডলার বের করেও তাকে দেখান।
কথা বলার ফাঁকে ইরানী ২ যুবক তাদের কাছে থাকা নেশা জাতীয় দ্রব্য (শয়তানের নি:শ্বাস) তার এবং তার ভাগ্নের চোখে ও মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর এতেই তারা দুজনই ‘সম্মোহিত’ হয়ে যান এবং প্রতারকের কথামত চলতে থাকেন।
এ সময় প্রতারক চক্রের সদস্যদের কথামত তিনি তার ক্যাশ বাক্স থেকে এক লাখ টাকা বের করে দেন। এরপর তারা দ্রুত চলে যায়। এ ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পর ব্যবসায়ী দুলাল মিয়ার বোধশক্তি ফিরে আসে। এ সময় তিনি বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
বিষয়টি তার প্রতিষ্ঠানের সিসি টিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে যায়। পরে যা ফেসবুকে প্রচার হলে ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় শিবগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ব্যাপারে আজ শুক্রবার (১১ আগস্ট) পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, দেশব্যাপি ‘শয়তানের নি:শ্বাস’ চক্রের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এ চক্রে দেশিয় অপরাধী চক্রের সাথে যুক্ত হয়ে অপরাধ করে আসছে আফ্রিকান ও ইরানী অপরাধী চক্রের সদস্যরা।
প্রথমে ঢাকায় আফ্রিকান চক্র এ ধরণের অপরাধ করেছে। কিন্তু এখন ইরানী অপরাধীরা চক্রের সদস্যরাও দেশিয় চক্রের সাথে যুক্ত হয়ে সাধারন মানুষের সাথে এমন প্রতারণা করে আসছে। পুলিশ সুপার আরও বলেন, শিবগঞ্জে ‘শয়তানের নি:শ্বাস’ ছড়িয়ে বিকাশের এজেন্টকে সম্মোহিত করে লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ওই দুই ইরানীকে গতকাল বৃহস্পতিবার নওগাঁ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এই চক্রের আরও দেশি ও ইরানী সদস্য রয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি অপরাধী চক্রের সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া বিদেশিরা এমন অপরাধ করার সাহস পাবেনা। পুলিশ সুপার বলেন, এর আগে ইরানী অপরাধী চক্রের এ সদস্যরা স্থানীয় অপরাধীদের সহযোগিতা নিয়ে যশোর ও নওগাঁয় একই ধরণের অপরাধ করেছে।
তিনি বলেন, ১১ আগস্ট গ্রেফতারকৃত ইরানী দু’জনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বগুড়ায় ইরানী অপরাধী চক্রের তৎপরতা এবং তাদের আরও সদস্যদের গ্রেফতার করতে এই দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামী রোববার আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। তবে তারা ফার্সি ভাষায় কথা বলে। সেইসাথে তারা কিছুটা বাংলা ভাষাও জানে। তাই জিজ্ঞাসাবাদকালে ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হবেনা বলেও তিনি জানান।
এ দিকে, শিবগঞ্জ থানার ওসি মো: আব্দুর রউফ বলেন, গ্রেফতারকৃত দুই ইরানী যুবক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসে। কিন্তু তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ বহুদিন আগেই শেষ হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে। যে কারনে তারা অপরাধের পথ বেছে নিয়েছে। ওসি আরও বলেন, তবে তারা চতুর । তারা আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের সদস্য।
উল্লেখ্য এর আগেও বগুড়া শহরে একই ধরণের প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন মাহবুবা সুরাইয়া নামে এক নারী। চক্রটি তার ওপর কৌশলে ভয়াবহ মাদক স্কোপোলামিন বা ‘শয়তানের নি:স্বাস’ প্রয়োগ করে। পরে এতে তিনি বশিভূত হয়ে পড়েন এবং নিজের হাতেই গলা হতে সোনার চেইন ও কানের দুল খুলে তাদের হাতে তুলে দেন।
চক্রের সদস্যরা তাকে সম্মোহিত করে তার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ১৩ আনা ওজনের সোনার গহনা হাতিয়ে নেয়। শহরের নাটাইপাড়ার বাসিন্দা মাহবুবা সুরাইয়া বলেন,তিনি ফতেহআলী বাজার থেকে গুড় কিনে চাঁদনী বাজারে গিয়ে তোয়ালা কিনছিলেন। কিন্তু এ সময় তিনি ওই ভয়ংকর প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েন। প্রথমে প্রতারক চক্রের হলুদ রং এর সার্ট পড়া এক সদস্য তার কাছে আসে।
এরপর তার হাতে থাকা একটি ব্যাগ দেখিয়ে বলে এর ভিতরে কেক বানানোর দামি পাউডার আছে। পাউডারগুলো বিক্রি করতে তার অসুবিধা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মাস্ক পড়া চক্রের আরেক সদস্য তার কাছে এসে বলে আপা ছেলেটির মা অসুস্থ, আমরা তাকে সাহায্য করতে পারি। এ সময় তিনি বলেন, আমি তাকে চিনি না।
আমি সাহায্য করতে পারবো না। এর ৫ মিনিটের মধ্যে আবার তাদের আরও এক সদস্য সেখানে হাজির হয় এবং পাউডারসহ ব্যাগ খুলে রেখে তার সাথে কথাবার্তা শুরু করে। কিন্ত এক পর্যায়ে তিনি ওই পাউডারের গন্ধে সম্মোহিত হয়ে পড়েন। এরপর তাদের কথামত চলতে শুরু করেন।
এক পর্যায়ে তিনি নিজেই গলা থেকে ১৩ আনা ওজনের একটি সোনার চেইন এবং সোনার দুটি কানের দুল খুলে তাদের হাতে দেন এবং তাদের পিছু পিছু চলতে থাকেন। এরপর তিনি শহরের সাতমাথা এলাকায় বাটার জুতার শোরুমের সামনে নিজেকে আবিস্কার করেন।
শুধু এ ঘটনাই নয়, এরপর শহরের চেলোপাড়া ও মাটিডালি এলাকায় দুজন নারী একই প্রতারক চক্রের কবলে পড়েছিলেন। এ ছাড়া শহরের নিউ মাকেটের এক ব্যবসায়ীও তাদের কবলে পড়ে টাকা খুঁইয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারক চক্রটির আরও কৌশল রয়েছে। তা হলো চিরকুটে লেখা ঠিকানা জানতে চেয়ে অথবা কারন ছাড়াই হ্যান্ডশেক করতে আসবে। এরপর ‘শয়তানের নি:শ্বাস বা স্কোপোলামিন ছড়িয়ে দিয়ে সম্মোহিত করে মানুষের কাছ থেকে সব কিছু হাতিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, স্কোপোলামিন নামক ড্রাগ মূলত লিকুইড ও শুকনো ধরনের হয়। এটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। এই ড্রাগ ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ২০ থেকে ৬০ মিনিট।
আবার এই মাদক খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিনদিন। এ মাদক গ্রহণে ভুক্তভোগীরা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগটি লুফে নেয় প্রতারকরা। নারীরা এ ব্যাপারে বেশি সাবধান থাকতে হবে।