শ্রীমঙ্গলের একটি টি-কেবিনে ৭ রকম বর্ণের একটি বিশেষ চা পাওয়া যায়। সাত রং চা নামেই এটি বিখ্যাত। এই সাতরঙা চা নিয়ে আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন। কোথেকে এলো এই সাত রং চা, কিভাবে এটি বানানো হয় এবং এই চা খেতে কোথায় যাবেন, বিস্তারিত পড়ে জেনে নিন…
চা আমাদের দেশে সাধারণ পানির পর সবচেয়ে বেশি পানকৃত পানীয়। কথিত আছে এদেশে চায়ের আগমন ব্রিটিশদের হাত ধরে, যদিও চায়ের আদি আবাস চীনে কিন্তু চিনের সাথে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণে ভারতে এসে চা উৎপাদনের কাজ শুরু করে বৃটিশরা। সেটাও প্রায় ১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে। আসাম অঞ্চলে বানিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনে অস্বাভাবিক ভাবে সফল হওয়ায় তারা তা উৎপাদনে আরো মনযোগী হয়। বাংলাদেশের সিলেটে চা এর উপস্থিতি প্রায় ১৮৫৫সালের গোড়ার দিকে। ১৮৫৭ সালের দিকে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বানিজ্যিক চা উৎপাদন শুরু হয়। উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য সিলেটে চা এর ফলন ভাল হয় , এবং শ্রীমঙ্গল এর মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত হওয়ায় সিলেটের শ্রীমঙ্গলকে চায়ের দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল
চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল মানেই যে শুধু চা গাছের সারি তা নয়। এটি হচ্ছে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের অপরূপ বাহার। প্রায় সকল পর্যটকই এর নিগূঢ় সৌন্দর্যে মাতাল হন। ছোট টিলার ন্যায় পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা শান্ত চা বাগান, হাওড়ের বিস্তীর্ণ জলরাশি, সবুজ বনানী এখানে সৃষ্টি করেছে অপরূপ সৌন্দর্যের এক স্বর্গীয় দৃশ্য। তাই সিলেটের অন্যান্য যায়গার চেয়ে তুলনামূলক ভাবে দর্শনার্থীদের আনাগোনা বেশী এই শ্রীমঙ্গলেই। শ্রীমঙ্গলের চা বাগান, বাইক্কা বিল, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক তাই সবসময় থাকে পর্যটকদের পদচারনায় মুখর। চায়ের দেশের বিখ্যাত খাবারের মধ্যে চা থাকবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপারই, তবে এখানের বিখ্যাত একটি চা রএছে যেটা কিন্তু আর দশ যায়গার মত সাধারন কোন চা নয়। চা এর নামটাও বেশ চমৎকার সাতরঙা চা, চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল বেড়াতে এসে সেখানের নীলকণ্ঠ চা কেবিনের সাতরঙা চা এ চুমুক দেননি এমন লোক খুজে পাওয়া কষ্ট। শুধু কি দেশ? এর সাথে বিদেশিদের কাছেও বিখ্যাত এই সাতরঙা চা, যা এখন হয়ে উঠেছে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের অন্যতম এক অনুষঙ্গ।
সাত রং চা কোথায় পাবেন
শুরুরদিকে শুধু একজায়গায় থাকলেও এখন বেশকিছু যায়গায় রয়েছে এই সাত রং চা এর উপস্থিতি, তবে মূল সাতরঙা চা বলতে নীলকন্ঠ কেবিনের চা কেই বোঝানো হয়। শ্রীমঙ্গলে বধ্যভূমি, বিডিআর ক্যাম্প ও কালীঘাট এই তিন যায়গায় নীলকণ্ঠ চা কেবিন আছে তিনটি। সিলেটের গন্ডি ছাড়িয়ে এখন রাজধানীর ঢাকার অন্যতম ব্যাস্ত এলাকা খিলগাও এর তালতলাতেও এই সাত রঙের চা পাওয়া যায়। চায়ের লম্বা গ্লাসে এক স্তরের ওপর ভেসে থাকে আরেক স্তর। প্রতিটি স্তরে ভিন্ন রঙ। ঠিক এক গ্লাসে সাত রঙের সাত স্বাদের চা। প্রতিটা রঙ ভিন্ন। একটি অপরটির সঙ্গে মিশে না। প্রতিটা রঙের স্বাদও আলাদা। এর স্বাদ নিয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক রয়েছে তবে স্বাদ যতটা না ভাল তারচেয়েও ভাল হচ্ছে এর সৌন্দর্যটা । সাত রঙের চা বলে খ্যাত হলেও বর্তমানে চা পাবেন আট রঙের। তবে আট রঙ বলালে আসলে ভুল হয়ে যায় আটটি ভিন্ন স্তরের চা। রঙ থাকে ২/৩টি। বিভিন্ন ধরণের মসলার ব্যবহারের তারতম্য, পানির ঘনত্বের চমৎকার বিন্যাস চায়ের এই স্তর সৃষ্টি করে।
সাত রং চা এর আবিষ্কারক
সাত রং চা এর উদ্ভাবন হলেন রমেশ রাম গৌড়রমেশ রাম গৌড়, যেহেতু এমন চা আগে কোথাও ছিল না তাই , বিশ্বের প্রথম রঙিন চায়ের আবিষ্কারক বলা হয় রমেশ রাম গৌড়কে। এর জন্যই এই রঙিন চা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও সুখ্যাতি লাভ করেছে। প্রায় ২০০২ সাল থেকে তিনি সাত রঙের এ চা বানিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্যই দিন দিন রঙিন চায়ের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে।
বর্তমানে তিনি সফল হলেও তার কর্মজীবনের শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার আটানিবাজারে একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর অংশীদার ছিলেন রমেশ । কিন্তু তাঁর অংশীদার পুরো টাকা আত্মসাৎ করে। দূর্ভাগ্য মেনে নিয়ে ভাগ্য বদলের উদ্দেশ্যে তিনি ২০০০ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে স্ত্রী, তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে চলে আসেন। সঙ্গে ছিল মাত্র দেড় হাজার টাকা। রামনগর মণিপুরীপাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে শহরের নতুন বাজারে একটি দোকানে চাকরি নেন। ওই বছরের আগস্টে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিটিআরআই) সংলগ্ন কাকিয়াছড়া চা বাগানে একটি চায়ের দোকান দেন। এরপর নিবিড়ভাবে চিন্তা ও পরিশ্রম করে ২০০২ সালে একই গ্লাসে দুই রঙা চা আবিষ্কার করে শ্রীমঙ্গলে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। ধীরে ধীরে চায়ের স্তর বাড়াতে শুরু করেন। বর্তমানে এটি আট স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে।
সাত রং চা এর রয়েছে অন্য রকম স্বাদ, যা সাধারণ চায়ের মতো না। এক কাপে সাত রঙের চা; এ যেন আকাশের রংধনুর মতোই বর্ণিল, এক এক স্তরে থাকে আলাদা আলাদা স্বাদ। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, একটি স্তর অপরটির সাথে মেশে না। চা-প্রেমীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন সাত রঙা চায়ের স্বাদ নিতে।
শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে এই চা পান করেননি, এমন মানুষ খুব কম রয়েছে। মানুষ শখের বসে এই চা পান করে থাকেন। অনেকে শুধুমাত্র এখানে আসেন সাত রঙের চায়ের স্বাদ নিতে।
এই চায়ের কিছু বিশেষ উপকরণ রয়েছে। সেগুলো হলো তিন ধরনের চা পাতা, দারুচিনি, ঘনীভূত দুধ, লেবু এবং লবঙ্গ। মিষ্টি স্বাদ থেকে শুরু করে ঝাঁঝালো লবঙ্গসহ সাতটি স্তরে থাকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। ওপরের স্তরটি দারুচিনি এবং নিচের স্তরটি লেবুর স্বাদ। এর পরের স্তরগুলোতে ঘনীভূত দুধের সাথে কালো চা থাকে এবং নিচের স্তরগুলোতে মিষ্টি, লবঙ্গসহ শরবত সবুজ চা এবং বিভিন্ন ধরনের মসলা থাকে।
উপকরণ: চা পাতা, চিনি, কনডেন্সড মিল্ক।
প্রণালী: প্রথমে ১ টেবিল চামচ চিনির সঙ্গে ২ টেবিল চামচ পানি মিশিয়ে সিরা করে নিতে হবে। পরিমাণমতো পানি এবং চাপাতা চুলায় জ্বাল দিয়ে লিকার তৈরি করে নিন। ১ টেবিল চামচ লিকার ও ১ চামচ সিরা মিশিয়ে রাখুন। তারপর ২ টেবিল চামচ কনডেন্স মিল্কের সঙ্গে ১ টেবিল চামচ লিকার মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর একটা কাপ-গ্লাসে প্রথমে প্লেন সিরা ঢেলে নিয়ে ২০ সেকেন্ড পরে সিরা মেলানো লিকার দিতে হবে। এর ৩০ সেকেন্ড পরে কনডেন্স মিল্কের মিশ্রণ দিতে হবে। তার ১ মিনিট পর বাকি লিকারটুকু গরম করে একদম কাপের ধার ঘেঁষে আস্তে আস্তে ঢালতে হবে। আরো ১ মিনিট পর পর কনডেন্স মিল্কের মিশ্রণ ও লিকার আস্তে আস্তে ঢালতে হবে।
এবার দেখুন সহজেই তৈরি হয়ে গেলো সাত লেয়ারের মজাদার রঙিন চা। এভাবেই পরিবার ও অতিথিকে চমকে দিন।
একটি স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে সাত রঙের ও স্বাদের চা পরিবেশন করা হয়। প্রথম লেয়ারে থাকবে দুধ, দ্বিতীয় লেয়ারে গ্রিন টি, এরপর দুধ চা, চতুর্থ লেয়ারে স্ট্রবেরি, তারপর সাদা চা, ব্লাক কফি এবং সর্বশেষ লেয়ারটি অরেঞ্জ। প্রতিটির কালার ভিন্ন। একটি অপরটির সঙ্গে মেশে না। প্রতিটি কালারের স্বাদও আলাদা। চামচ দিয়ে না ঘুটে যতই নাড়াচাড়া করুন এক স্তর অন্য স্তরের সঙ্গে মিশবে না।