Home খেলাধুলা ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের অপরাজিত মেয়েদের সাফল্যের গল্প

ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের অপরাজিত মেয়েদের সাফল্যের গল্প

ঢাকা: সানজিদা, শারমিন, রুপিয়া, রাশিদা— নামে ভিন্ন হলেও পরিচয়টা অভিন্ন। তারা সবাই ফুটবল খেলেন, খেলোয়াড়। জন্ম অজপাড়াগাঁয়ে হলেও খেলছেন জাতীয় পর্যায়ে। কেউ হকি, কেউ রাগবি, কেউবা বাস্কেটবল, আর্চারিতেও রয়েছে কারও কারও সাফল্যের তীলক। আরেক ক্ষেত্রের তাদের মিল রয়েছে।  আর তা হলো তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। একই স্কুলে পড়েছেন।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলটির অবস্থান জেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সালন্দর গ্রামে। এই বিদ্যালয়ের কমপক্ষে ১২ ছাত্রী জেলার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় অবদান রেখে চলেছেন। কেউ কেউ পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি এই ছাত্রীদের বিষয়ে সলুকসন্ধান করতে গিয়েই বেরিয়ে এলো সব খবরা-খবর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খেলাধুলায় অজপাড়া গাঁয়ের এই কিশোরীদের আগ্রহ ও অধ্যবসায়- সর্বোপরি এমন সাফল্যের পেছনে যিনি আছেন তারও অবস্থা প্রায় তাদের মতোই। তিনি একজন দরিদ্র শিক্ষক। নাম মাসুদ রানা, বয়স ৫০ কোটায় হলেও মনে এবং মননে তারুণ্যে ভরপুর।

মূলত তার অনুপ্রেরণায় ছাত্রীরা খেলাধুলায় এসেছেন। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তাদের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে মেয়েদের মাঠে নিয়ে আসতেন তিনি।

মাসুদ রানা বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল। তার ওপর আবার দারিদ্র্যের কষাঘাত। মেয়েদেরকে অনেকে স্কুলেই দিতে চায় না, তার উপর আবার খেলাধুলা! তবে এখন মেয়েরা ভালো করছে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। সেজন্য আমার যেমন গর্ব হয়, অভিভাবকেরাও খুশি।

সম্প্রতি মাসুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, দেশখ্যাত এই কিশোরীদের সাফল্যের এবং এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রামের দিনগুলোর গল্প। সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে ছেলেরা খেলত। আর মেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখত। শরীরচর্চার শিক্ষক মাসুদ রানা ভাবলেন, মেয়েরাও তো খেলতে পারে। কিন্তু মেয়ে খেলোয়াড় জোগাড় করা সহজ ছিল না। সামাজিক রীতিনীতি ও নানা কুসংস্কারের কারণে অনেক অভিভাবক মেয়েদের খেলতে দিতে চাইতেন না। মাসুদ রানা মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝালেন। কিন্তু অভিভাবকরা বাড়ির মেয়েদের মাঠে খেলতে দিতে রাজি নন। তবে মাসুদ রানা নাছোড় বান্দা। অনেক চেষ্টার পর এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে কয়েকজন অভিভাবক মেয়েদের খেলতে দিতে রাজি হলেন।

সময়টা ২০১৪ সাল। শরীর চর্চার শিক্ষক মাসুদ শুরু করলেন তার স্বপ্নের যাত্রা। সেবারই স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে হকি ও বাস্কেটবল দল গঠন করেন মাসুদ রানা। দল গঠন হলেও খেলাধুলার তেমন কোনো সামগ্রী ছিল না। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মেয়েদের পক্ষে জুতা-জার্সিসহ ক্রীড়াসামগ্রীর টাকা জোগান দেওয়াও ছিল কঠিন। তাই সাধারণ পোশাক আর খালি পায়েই মেয়েদের অনুশীলন চালাতে হয়েছে। এমনও হয়েছে যে মাঠের খড়কুটা আর আবর্জনায় পা কেটে রক্ত ঝরেছে, তবু মেয়েরা দমে যায়নি।

হকি খেলোয়াড় মোকছেদা আক্তার বলেন, ‘তখন কেবল হকি খেলা শুরু করেছি আমরা। সব খেলোয়াড়ের হকিস্টিকও ছিল না। তবে একটা জিনিস আমাদের ছিল, তা হচ্ছে- প্রত্যয়। যা দিয়ে আমরা এগিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করি।’

জানা যায়, ২০১৫ সালে এসে বিদ্যালয়ের হকি দলটা দাঁড়িয়ে যায়। সে বছর জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার হকি খেলায় অংশ নেয় সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা। জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয় তারা। এরপরই বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের খেলার প্রতি আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে যায়। ২০১৭, ২০১৮ সালেও জাতীয় পর্যায়ে মেয়েরা রানার্সআপ হয়। ২০২০ ও ২০২২ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা।

এই স্কুলের মেয়েরা জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বাস্কেটবলে একবার চ্যাম্পিয়ন, রানার্সআপ হয় তিনবার। ২০১৮ ও ২০২১ সালে যুব গেমসে সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েদের নিয়ে গড়া ঠাকুরগাঁও বাস্কেটবল দল চ্যাম্পিয়ন হয়।

সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েরা জাতীয় মহিলা রাগবিতে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়। আর সর্বশেষ যুব গেমসে ব্রোঞ্জপদক পায়। ব্যক্তি ও দলীয় পর্যায়ে সব মিলিয়ে দুই শতাধিক ট্রফি এখন বিদ্যালয়ের ঝুলিতে।

সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের মেয়েদের অর্জনের কথা শুনেছেন বলে জানালেন ঠাকুরগাঁও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা। তিনি বলেন, এই মেয়েরা সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নানা সংকটের মধ্যেও তারা খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। এটা বেশ আনন্দের।

তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে এই খেলোয়াড়দের সমস্যাগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানালেন তিনি।

এদিকে সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা করে অনূর্ধ্ব-২১ হকি নারী দলের সুযোগ পেয়েছেন ৬ জন। তারা হলেন- সানজিদা আক্তার (সাথী), রানী আক্তার, মোকছেদা আক্তার, তাসমিম আক্তার, জাকিয়া আফরোজ ও সিমু আক্তার। জাতীয় নারী বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় শারমিন আক্তার ও মুসলিমা আক্তার। রাগবির জাতীয় নারী দলে আছেন রুপিয়া আক্তার ও রুবিনা আক্তার। রোলবলের (রোলার স্কেটিং, বাস্কেট বল ও হ্যান্ডবলের সমন্বয়ে একটি খেলা) জাতীয় নারী দলে আছেন সানজিদা আক্তার (পলি) এবং আর্চারির জাতীয় নারী দলে রয়েছেন মনি আক্তার। খো খোর জাতীয় নারী দলে রাশিদা আক্তার ও লামিয়া আক্তার খেলছেন।

খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে ছাত্রীদের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। রাশিদা আক্তার জাতীয় খো খো দলের খেলোয়াড়। খেলোয়াড় কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। তিনি এখন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়ছেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে।

যোগাযোগ করা হলে রাশিদা বলেন, ‘মানুষের কটুকথা উপেক্ষা করে খেলাধুলার মধ্যে ছিলাম বলেই আজ আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছি। আমি স্বপ্ন দেখি এভাবে একদিন মেয়েরা এগিয়ে যাবেই।’

ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামের ৬ কিশোরী। অভাব আর সামাজিক বঞ্চনায় নিষ্পেষিত হলেও ফুটবলে গারো পাহাড়ের মতো দৃঢ় থেকে ২০২২ সালে সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তারা। গেল কয়েকবছর ধরে ফুটবল খেলে তারা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তাদের কল্যাণে গ্রামের মানুষ পেয়েছে বিদ্যুতের সুবিধা। শুধু তাই নয়, ক্রীড়া জগতে নারীদের মুখও উজ্জ্বল করেছেন কলসিন্দুরের এই কিশোরীরা। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে কলসিন্দুরের নাম। এই গ্রামের কৃতী সন্তান ফুটবলার সানজিদা বলেন, আমাদের গ্রামের মেয়েরা এখন আর পিছিয়ে নেই। আমরা সবাই মিলেমিশে স্বপ্ন দেখি ও সেই স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা করি।

শরীরচর্চার শিক্ষক মাসুদ রানা বলেন, আসলে এই মেয়েদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মনবলের ওপর ভর করেই তারা এগিয়ে যায়। কারণ তাদের খেলার সরঞ্জামের সংকট আছে। আছে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব। অনেককে এলাকার মানুষের কটু কথাও শুনতে হয়।

নিজের স্কুলের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার বিদ্যালয়ে কোনো বাস্কেটবল কোর্ট নেই। অনুশীলনের জন্য সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মেয়েদের জেলা শহরে যেতে হয়। প্রান্তিক পরিবারের সদস্য হওয়ায় খেলাধুলার জন্য যে ধরনের পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন, তা পায় না এই মেয়েরা। খেলার জন্য একজোড়া ভালো বুটও নেই তাদের অনেকের।
মাসুদ রানা বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ের মেয়েদের মধ্যেও প্রতিভা রয়েছে। আমি তাদের প্রতিভাকে শাণ দিয়ে যাচ্ছি মাত্র। অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি নারী খেলোয়াড়দের দেশের বিভিন্ন বাহিনীতে খেলোয়াড় কোটায় চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে মেয়েদের এ সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব।

সালন্দর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল আলম বলেন, মেয়েদের খেলাধুলা চালিয়ে নিতে অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা জাতীয় পর্যায়ে আরও প্রতিভাবান খেলোয়াড় জোগান দিতে পারবেন।

মেয়েরা ফুটবল খেলবে, একসময় গ্রামবাংলায় এটা ছিল অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে কলসিন্দুরের মেয়েরা। প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে টানা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে তারা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে দেশের হয়েও বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জিতেছেন অদম্য এই কিশোরীরা। এই ‘দ্য আনবিটেন গার্লস’ (অপরাজিত মেয়েরা)-এর গল্প এখন একাদশ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে পঠিত হচ্ছে অন্য মেয়েদের অনুপ্রেরণা হিসেবে। এভাবেই দেশজুড়ে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সানজিদা-মারিয়া কিংবা রুপিয়ারা। যারা একটু সুযোগ পেলেই হয়তো বাংলাদেশের নারীদের সক্ষমতার জানান দেবে বিশ্বজুড়ে একেকজন ‘দ্য আনবিটেন গার্লস’ হয়ে।

বাসস