ইমরান আলী:
শাহজালালসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন কারণে স্বর্ণ ধরা পড়ছে বলে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। একই সঙ্গে ধরা পড়ার বাইরে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দুটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বর্ণ চোরাচালান ও এর সঙ্গে জড়িতদের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে এক গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
ধরা পড়ার নেপথ্যের তিন কারণ : গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে স্বর্ণ চোরাচালান ধরা পড়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চোরাচালানিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে এক সিন্ডিকেট অপর সিন্ডিকেটের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বা বিমানবন্দরে কর্মরত কাস্টমস ও কাস্টমস গোয়েন্দাদের আগেই খবর দিয়ে দেয়। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিমানবন্দরে নিযুক্ত বিভিন্ন সংস্থার কিছু সদস্যের পারস্পরিক সমঝোতার অভাব। এক্ষেত্রে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের ভাগবাঁটোয়ারায় কমবেশি হওয়ায় নিজেদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের তথ্য ফাঁস করে দেয়। তৃতীয় ও সর্বশেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাচারকারীদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া। এক্ষেত্রে উৎকোচ কমবেশি হওয়ার কারণেও তথ্য ফাঁস করে দেয়।
তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উপকমিশনার সানোয়ারুল কবির বলেন, বিমানবন্দরে কর্মরত সবাই আগের যে কোনো সময়ের চাইতে আন্তরিক। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধির কারণে স্বর্ণের চোরাচালান ধরা পড়ছে।
বিমানবন্দরে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণের ট্যাক্স একসময় কম ছিল বলে সে সময় চোরাকারবারিরা রেন্ট-এ-ক্রাউড পদ্ধতিতে স্বর্ণ নিয়ে আসতো। অর্থাৎ দুবাই, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া থেকে ৪০ জন যাত্রী ভাড়া হতো। এক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেককে একটি করে বার দিয়ে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিয়ে শাহজালালে এসে বারগুলো ট্যাক্স দিয়ে নিয়ে নেয়া হতো। পরে স্বর্ণের ট্যাক্স বেড়ে যাওয়ার ফলে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনার প্রবণতা বেড়ে যায়। চোরাকারবারিরা বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে চোরাচালান করতে থাকে। কিন্তু যখন বনিবনা হয় না, তখনই ধরা পড়ে একথা সত্য। এছাড়াও বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা এখন অনেক বেশি আন্তরিক।
তিনি বলেন, এই পদ্ধতি ছাড়াও চোরাকারবারিরা বিমানের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বিমানের ভেতর বড় বড় স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে আসার ঘটনা রয়েছে। তবে বর্তমানে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বনের কারণে স্বর্ণ ধরা পড়ার ঘটনা বেশি।
স্বর্ণ চোরাচালানের রুট : গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রুট ব্যবহার করে স্বর্ণ ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাকারবারিরা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণের চালানগুলো দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী হয়ে দেশে প্রবেশ করে। পরে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে সেগুলো বাইরে নিয়ে আসা হয়। এরপর সেগুলো বিশেষভাবে বেনাপোল ও ভোমরা সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে যায়।
এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ভারতে এখন অলংকার প্রস্তুতকারী ছাড়া কেউ স্বর্ণ আমদানি করতে পারে না। অথচ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে যে পরিমাণ স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে তা শুধু গয়না প্রস্তুতকারীদের পক্ষে আমদানি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বর্ণের চাহিদা মেটাতে চোরাচালান পথে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করছে।
স্বর্ণ চোরাচালান প্রক্রিয়া : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে স্বর্ণের অবৈধ চালানের একটি বড় অংশ আসে দুবাই থেকে। ক্ষুদ্র চালানগুলো বাংলাদেশে বিমানবন্দরে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কিছু অসাধু ব্যক্তির সহায়তায় বিমানবন্দরের বাইরে চলে আসে। এছাড়া বৃহৎ চালানগুলো পাচারে বিমানকে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে স্বর্ণ বহনকারী ব্যক্তি বিমানের সিট অথবা টয়লেটে রেখে বিমানবন্দর ত্যাগ করে। পরে বিমানের কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে সে স্থান থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করে বাইরে বের করে দেয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিমানগুলো বিমানবন্দরে অধিক সময় অবস্থানের কারণে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিরা বিমান থেকে অবৈধ স্বর্ণ সংগ্রহের বেশি সময় পায়। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বর্ণের বড় চালানগুলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিভিন্ন ফ্লাইটে আসে। একটি বড় স্বর্ণের চালানের সঙ্গে একাধিক সিন্ডিকেট জড়িত থাকে। এরা এদেশে পাচারকৃত স্বর্ণ সংগ্রহ করে পরে ভারতে পাচার করে দেয়। জড়িত সিন্ডিকেটগুলো স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য স্বর্ণগুলো দেশের বা বিদেশের বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির মাধ্যমে ক্রয় বিক্রয় বা লেনদেন হয়ে থাকে।
জব্দ হওয়া সোনার চালান : শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১৩২ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৭৪.৪৯ কেজি এবং ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ১৮০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এছাড়াও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সর্বোচ্চ মোট ৭১৯ কেজি ২৪৬ গ্রাম চোরাচালানের সোনা জব্দ করা হয়। এছাড়াও শুল্ক কর্তৃপক্ষের প্রিভেনটিভ টিম, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি অভিযানেও স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, স্বর্ণ চোরাচালানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এদেশ হতে দুবাই বা অন্যান্য দেশে যাওয়া বিভিন্ন বিমান সংস্থার পাইলট, কো-পাইলট, কেবিন ক্রু, স্টুয়ার্ড ইত্যাদি ব্যক্তিরা। বিমানবন্দরে এসব ব্যক্তির চেকিং ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সময় এরা চোরাকারবারিদের দেয়া প্রচুর অর্থ বহন করে নিয়ে যায়, যা ওই দেশে স্বর্ণ কেনার কাজে ব্যবহূত হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুর রউফ বলেন, শুধু স্বর্ণ নয় যে কোনো চোরাচালান রোধে বন্দরগুলোতে আগের চেয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যার ফল হিসেবে আটক হওয়ার ঘটনা বাড়ছে।
তিনি বলেন, এ নজরদারি অব্যাহত থাকবে। যে কোনো চোরাচালান পণ্য রোধে আমরা বদ্ধপরিকর।