এখন থেকে ৬০/৬৫ বছর আগে, আমাদের স্কুল জীবনে, অনেকেরই শখ বা হবি ছিল পত্র মিতালী বা পেন ফ্রেন্ডশিপ, ডাক টিকেট ও অটোগ্রাফ সংগ্রহ অথবা গান শোনা। তখন তো ক্যাসেট প্লেয়ার কিংবা সিডি – ডিভিডি ছিল না, যাদের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল, তাদের কাছে নতুন নতুন রেকর্ড সংগ্রহও ছিল শখের ব্যাপার।
১৯৫৫ – ৫৬ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম স্কুলে ক্লাস নাইন – টেনে পড়ার সময় বন্ধুদের দেখাদেখি দুই একজন পেনফ্রেন্ড জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সুবিধা করতে পারিনি। সেই আমলে কিছু পত্র- পত্রিকায় পত্র মিতালীতে আগ্রহী ছেলে- মেয়েদের নাম- ঠিকানা ছাপা হতো। তবে মজার ব্যাপার, এখন যেমন ফেসবুকে ভুয়া নাম- ঠিকানা অথবা কোন মেয়ের নাম- ছবি ব্যবহার করে ছেলেদের অ্যাকাউন্ট খোলার কথা শোনা যায়, তখনও তেমনটা দেখা গেছে। আমি এমনি এক ভুয়ার খপ্পরে পড়েছিলাম। পরে দু’ জন বিদেশি বন্ধু পাওয়া গেল। ভেবেছিলাম তাদের সাথে লেখালেখি চালিয়ে গেলে কিছুটা ইংরেজি চর্চা হবে। কিন্তু বিদেশে চিঠি লিখতে যে ডাক মাশুল লাগে তা সব সময় জোগাড় হতো না।
১৯৬০’ এর দশকের মাঝামাঝি করাচিতে চাকরি করার সময় আবার সেই পুরনো শখ জাগলো মূলত দুটি কারণে। মেসে থাকি, সাতটা – দুটো অফিসের পর হাতে অনেকটা সময়। মেসে সবাই মিলে ইংরেজি DAWN পত্রিকা রাখা হতো আর আমি নিজে রাখতাম সাপ্তাহিক চিত্রালী। চিত্রালীর চিঠিপত্র বিভাগ তখন খুব জনপ্রিয় ছিল। আমি নিয়মিত নামে- বেনামে চিঠি লিখতাম, তারমধ্যে ‘ হাসান বাঙ্গালী ‘ নামটি বহুদিন বজায় ছিল। তো এই চিতালীর মাধ্যমে তখন কয়েকজন তরুণ- তরুণীর সাথে ( আমার বয়স ২৫/২৬ ) চিঠিপত্রের মাধ্যমে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদের কয়েকজনের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে সবাই যে যার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় শেষপর্যন্ত আর সম্পর্ক ধরে রাখা যায়নি। আমি বিভিন্ন সময়ে এই পেনফ্রেন্ডদের কয়েকজনকে নিয়ে পত্রিকায় গল্প লিখেছিলাম, কিছুদিন আগে একবার ফেসবুকেও লিখেছি। আজকের লেখায় আমার সেই পুরনো কলমবন্ধুদের একজনের কথা স্মরণ করবো, চার দশকের বেশি সময় পর যার সঙ্গে সম্প্রতি ঘটনাচক্রে আমার ফোনে কথা হয়েছে।
১৯৬৬ – ৬৭ সালে যখন পত্রমিতালীসূত্রে তার সাথে আমার পরিচয়, তিনি ঢাকায় ইডেন কলেজে উচ্চ- মাধ্যমিকের ছাত্রী, নাম দেয়া যাক পারভীন সুলতানা ( নামে কী আসে যায় ! ) । পারভীন তার চিঠিতে যেমন এবং যে সব বিষয়ের অবতারণা করতেন, আমিও সেই ভাবেই জবাব দিতাম। তিনি প্রধানত সাহিত্য- সংস্কৃতি, সিনেমা, সমকালীন রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন। বয়সের অনুপাতে তাকে এসব ব্যাপারে বেশিই সচেতন মনে হতো। তার বাবা একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, বড়ভাইটি উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে, স্বভাবতই পারিবারিক পরিবেশ থেকেই তিনি এই সচেতনতার শিক্ষা পেয়েছেন। পারভীন চিঠিতে আমাকে ভাইয়া সম্বোধন করতেন, আমিও তাকে বোন বলেই ভেবেছি।
১৯৭১ সালের শুরুতে আমি করাচি থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসি। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানে পারভীনের সাথে আমার প্রথম সামনাসামনি দেখা হয়। আমাদের মধ্যে আগেই ছবি বিনিময় হয়েছিল ফলে পরস্পরকে চিনতে সমস্যা হয়নি। সেদিন তার সঙ্গে তার ছোটবোন নাজনীনও ছিলেন। দেখা হওয়ায় আমরা উভয়েই আনন্দ অনুভব করেছিলাম। পঁচিশে মার্চ রাতে আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর ঢাকা শহরে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। পরিচিতজনদের কে কোথায় কী হালে আছে, জীবিত না মৃত — কেউ কিছু জানে না। ওই রাতের পর আমি নয়া পল্টন এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। খুব সম্ভব আটাশে মার্চ সকালে কয়েক ঘন্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেয়া হয়েছিল। আমি সেই ফাঁকে হেঁটে হেঁটে আজিমপুর কলোনিতে পারভীন সুলতানাদের বাসায় গিয়ে হাজির হলে ওরা সবাই খুব অবাক হয়েছিলেন। একজন সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, সেই অর্থে খুব পরিচিতও নয়, ওই দুর্যোগের মধ্যে কুশলাদি জানতে এসেছে — অবাক হওয়ারই কথা।
এরপর পারভীনের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার টেলিফোনে কথা এবং ঢাকায় বসেই পত্র বিনিময় হলেও আর কখনও দেখা হয়নি। এরমধ্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। পারভীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে একটি স্কুলে চাকরি নিয়েছেন এবং সর্বোপরি পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে একজন বিশিষ্ট সাংবাদিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। এই পর্যন্ত খবর জানার পর আমি রাজশাহী বদলি হয়ে আসি, পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগও ছিন্ন হয়ে যায়। আমি জানতাম স্বামী- সংসার নিয়ে সে সুখে আছে, আমার মতো তুচ্ছ পরিচয়ের একজন মানুষের সেই সংসারে প্রবেশাধিকার নেই।
কিছু শারীরিক সমস্যার কারণে কয়েক বছর থেকে আমি সম্পূর্ণ গৃহবন্দি। দিনের অনেকটা সময় কাটে বই- পত্রিকা পড়ে আর টেলিভিশন দেখে। মাস দুয়েক আগে এক সকালে একটি বেসরকারি চ্যানেলে ‘ নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় এনজিওদের ভূমিকা ‘ বা এই জাতীয় একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। টিভি অনুষ্ঠানের আরেক নাম বিজ্ঞাপন অনুষ্ঠান সুতরাং আমি সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে দৈনিক পত্রিকায় মনোযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই পারভীন সুলতানা নামটি কানে আসতেই দৃষ্টি ফেরালাম। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান নির্বাহী পারভীন সুলতানার বক্তব্য শুরু হয়েছে। ষাটোর্ধ মহিলার পরনে সাদার ওপর প্রিন্টের শাড়ি, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চেহারায় বয়েসের ছাপ। নামটি অতি চেনা হলেও ওই নামের মানুষটির মধ্যে দীর্ঘ ৪৫ বছর আগে দেখা একজনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই, সেকথা জেনেও স্মৃতির আলমারিটার দুটি পাল্লা খুলে বহুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইলাম। ততক্ষণে আলোচনা অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে।
টিভিতে পারভীন সুলতানাকে যে সংস্থার প্রধান নির্বাহী বলা হয়েছিল, সেই নামটি বেশ পরিচিত। দু’দিন পর আমি ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে সহজেই ওই প্রতিষ্ঠানটির পরিচয়, কার্যক্রম — এমনকি যোগাযোগের ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বারও পেয়ে গেলাম। টেলিফোন করে নিজের পরিচয় দিতেই খানিক বাদে পারভীন সুলতানাকে পাওয়া গেল। রিসিপসনিস্টের মুখে আমার নাম শুনে পারভিন প্রথমেই ” আরে হাসান ভাই — আপনি, এতদিন বাদে কোথায় আমার খোঁজ পেলেন ? এখন থাকেন কোথায় — ” একথা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। আর আমিও যে ভুল ঠিকানায় হাজির হইনি — একথা ভেবে স্বস্তি বোধ করলাম। পারভীন আমার ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে বললেন : এখন অফিসে বসে গল্প করা যাবে না, আমি রাতে বাসা থেকে কথা বলবো, আপনার অসুবিধা হবে না তো ? রাতে দীর্ঘ সময় পারভীনের সাথে কথা হলো। তিনি আমার যাবতীয় খবর নিলেন, তার কথাও জানালেন সবিস্তারে। টেলিফোন রাখার পর একবার মনে হলো — এতদিন পর পারভীনের সাথে যোগাযোগ হওয়া কি খুব জরুরি ছিল ? আমি এতদিন যেমন জানতাম তিনি স্বামী- সংসার- সন্তান নিয়ে সুখে আছেন, সেটাই কি ভালো ছিল না ?
পাঠক, হয়তো কৌতুহলী হচ্ছেন, সংক্ষেপে বলি। বিয়ের আট বছর পর তাদের স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। পারভীন সব খুলে বলেননি তবে পারস্পরিক আস্থার অভাব একটা বড় কারণ ছিল বলে মনে হয়েছে। এরপর দুটি সন্তান নিয়ে পারভীনের জীবন – যুদ্ধ শুরু হয়। তার প্রাক্তন স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে একই শহরে নিরাপদ দূরত্বে বাস করছেন। পারভীনের বড় ছেলেটি আফ্রিকার একপ্রান্তে আলজেরিয়া সরকারের চাকরি নিয়ে সেখানেই বাস করছে, কবে দেশে ফিরবে ঠিক নেই। ছোটটি মেয়ে, তার স্বামী দু’বছর আগে ক্যানাডায় অভিবাসী হয়েছে। আর পারভীন মিরপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় একাই থাকেন। একসময় তার মা সঙ্গে থাকতেন, গতবছর তিনি পরপারের যাত্রী হয়েছেন। কাছেই অন্য একটি বাড়িতে সপরিবার পারভীনের ভাই থাকেন, তিনি নিয়মিত খোঁজখবর নেন। পারভীন খুশির ভাব নিয়েই বললেন — এই তো বেশ আছি। ছেলেমেয়ে দুটি ভালো আছে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। আরও বছর দুয়েক এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করবো, তারপর অবসর। দেড় কোটি মানুষের এই শহরে আমি তো আসলে একা, তখন কীভাবে সময় কাটবে জানি না। হয়তো গ্রামের বাড়ি চলে যাবো, সেখানে চাচাতো ভাইবোনেরা আছে, বাকি দিনগুলো কেটে যাবে। একজন মানুষ কতদিনই বা বাঁচে ….. ।