ওয়ান ইলেভেনের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়ে। আর তৎকালীন প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছিল চিটাগাং চেম্বার। চেম্বারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন সে সময়কার পরিচালক মো. আমিরুল হক। সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারে চট্টগ্রাম বন্দরে কোন যন্ত্রপাতি সংযোজন হয়নি, কেবল সিস্টেমের পরিবর্তনের কারণে বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তখন বেশি প্রয়োজন ছিল ডক শ্রমিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ড এবং স্টিভিডোরস স্টাফ ইউনিয়ন ভেঙে দেয়া। এই দু’টি ভেঙে দেয়ার কারণে কথায় কথায় কাজ বন্ধ করে দেয়ার জিম্মি অবস্থা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিত্রাণ লাভ করে। গত ১০ বছরে একদিনের জন্যও বন্দর বন্ধ হয়নি রাজনৈতিক কারণে। সেই ‘খারাপ লোক’গুলো যদি থাকতো, তাহলে কেউ না কেউ তাদেরকে খারাপ স্বার্থে ব্যবহার করতো।
সংস্কারের এই স্থপতি বেশ ক্ষোভে আরও বললেন, যেসব খারাপ প্রথা একবার বিলোপ করা হয়েছে, সেগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি তৎপর হয়ে ওঠেছে সাম্প্রতিককালে। সেই প্রথাগুলো যাতে আর না আসে সে ব্যাপারে সক্রিয় থাকতে হবে প্রশাসন এবং বন্দর ব্যবহারকারীদেরকে। শ্রম অধিকার আদায়ের জন্য ইউনিয়ন যেটা আছে সেটাই যথেষ্ট। এই ব্যবসায়ী নেতা সংস্কার তৎপরতায় নিজের সংশ্লিষ্টতার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘ চালক, উইঞ্চম্যান নেয়ার জন্য জোর-জবরদস্তি বেআইনি। এটাকে উৎসাহিত করা উচিৎ নয়। সেটা বাদ দেয়ার প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলাম। বহু রকমের ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। বন্দর অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস। কেউ যেন এটাকে নিয়ে রাজনীতি করতে না পারে সেই চেষ্টা ছিল আমার।’ ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারের সুফল হিসেবে নিরবচ্ছিন্নভাবে বন্দর চালু রয়েছে গত এক দশক ধরে। সাবেক ব্যবসায়ী নেতা ও সীকম শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, সরকার মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। পায়রায় বন্দর তৈরি করছে। এগুলো থেকে সুফল আসতে সময় লাগতে পারে ২০ বছর। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সুফল পেতে সময় লাগবে না। আজ সক্ষমতা বাড়ালে কাল থেকে রেজাল্ট পাওয়া যাবে। বুড়িগঙ্গার তীরে টার্মিনাল তৈরি হয়েছে, বেসরকারি টার্মিনালও হয়েছে। কিন্তু সেখানে ব্যবসায়ীরা যেতে চান না। চট্টগ্রাম বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরই, ভৌগোলিকভাবে এই বন্দরের গুরুত্ব অনেক। এই বন্দর থাকলে সেভেন সিস্টারসকে সেবা দেয়া যাবে। এটাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা গেলে চীনের কুনমিং পর্যন্ত সার্ভিস বিস্তৃত করা যাবে। কিন্তু বর্তমান সক্ষমতায় ইচ্ছা থাকলেও সার্ভিস দেয়া সম্ভব হবে না। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি থাকবে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নকে সরকারের ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। এই বন্দরের উন্নয়ন হলে দেশের উন্নয়ন হবে। আরেকটা জিনিস যা করা দরকার ছিল তা হলো রিয়াল টাইম অপারেটর সিস্টেম। বার্থ অপারেটর, টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগ করা হয়েছে। এদের অপারেটর হিসেবে কেবল নাম রয়েছে। আর কিছু নেই। একটি ইকুইপমেন্টও নেই। অপারেটরদের অবশ্যই পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট থাকতে হবে। বর্তমান অপারেটররা এক্ষত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। ফর্কলিফট, ট্রাক্টর ট্রেইলর তারা যুক্ত করতে পারেন। তাতে সক্ষমতা বাড়তো। এই বন্দরের বড় প্রকল্প বে টার্মিনাল। বন্দর বিস্তৃতি লাভ করছে মিরেরসরাই পর্যন্ত। বে টার্মিনাল আংশিকভাবে হলেও যদি চালু করা না হয়, তাহলে এ বছরের পরে বর্তমান সক্ষমতায় কাজ করতে পারবে না বন্দর। প্রত্যেকটি সূচক বলছে রপ্তানি আয় কম। সেই তুলনায় বাড়ছে আমদানি। যে কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে গেলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত যে মহাসড়ক সেটাকে ৮ লাইনে উন্নীত করতে হবে, ত্বরিৎ গতিতে চালু করতে হবে বে টার্মিনাল। বন্দর ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, কার ব্যথাটা কোথায় সেটা বলতে পারবে বেসরকারি । স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে সভা করাটা যথেষ্ট নয়। এই বিষয়ে ভাল জানেন এমন অনেকে আছেন। তাদের সাথে মত বিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নির্মিয়মান বে টার্মিনাল এলাকার আশেপাশে প্রচুর জায়গা। সেখানে ৩০ একর করে ২০টা আইসিডি করার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে যেসব আইসিডি শহরের মধ্যে আছে সেগুলোও সেখানে স্থানান্তর করা যেতে পারে পর্যায়ক্রমে। রাজধানীর পোস্তগোলা থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়েছে অনায়াসে। আর আইসিডিতে তো এমন কোন ক্যাপিটাল মেশিনারি নেই যে স্থানান্তর করা যাবে না। আইসিডিগুলো স্থানান্তর হলে যানজট কমবে। ইপিজেড সরানো যেতে পারে শহর থেকে। বেজার ওখানে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে ইপিজেড। স্টিল মিল ভেঙে সেখানে ইপিজেড করাটা সঠিক হয়নি। তা না করে সেখানে বন্দরের ব্যাকআপ সুবিধা তৈরি করা যেতো। এ প্রসঙ্গে বলেন, বন্দর কেবল বন্দর এলাকায় হতে পারে, আর কোথাও নয়। কিন্তু ইপিজেড যে কোন স্থানে হতে পারে। মিরেরসরাই, নিলফামারি, সৈয়দপুরে ইপিজেড গড়ে তোলা যাচ্ছে । কিন্তু বন্দর সৈয়দপুরে নিয়ে যেতে পারবেন না। তিনি অভিমত দেন, যুগের প্রয়োজনে বন্দরের জায়গায় বিভিন্ন শিল্প গড়তে দেয়া হয়েছিল। এর যেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, সে জায়গা কেবল বন্দর ভিত্তিক সুবিধা তৈরির জন্য নির্দিষ্ট রাখতে হবে। দেশের অর্থনীতি ও ক্রমবর্ধমান আমদানি রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রধান বন্দরটির হিমশিম অবস্থা। কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি করতে সরকারের একশ’টি ইকোনমিক জোন গড়ার পরিকল্পনা দৃশ্যমান হতে থাকায় আগামীর চাহিদা সামাল দিতে বন্দরের অনেক পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের গতি ধীর। আশা করেন, আাগামীতে আমাদের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও ভাল হবে। লালফিতার দৌরাত্ম্য কমবে, বন্দর সেবাও আরও বাড়বে। এখনও শ্রমিক মজুরি আমাদের দেশে শিল্পের অনুকূলে। অন্যান্য দেশে যে মজুরি ২০০ ডলার, আমাদের দেশে তা ১০০ ডলারের কম। আমাদের লোকজন কাজের প্রতি আন্তরিক। ডেলসি, স্যামসোনাইটের মত বড় বড় ব্যাগ কারখানা এখানেও হবে। শ্রমনিবিড় অনেক শিল্প এখানে চলে আসবে। তা সামাল দেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে বন্দরের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংকে প্রধানমন্ত্রীর ফাস্টট্র্যাক কর্মসূচিতে নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। শুধু বে টার্মিনাল করে বসে থাকলে হবে না, মিরেরসরাই পর্যন্ত বন্দর সুবিধা কিভাবে তৈরি করতে হবে সেটা নিয়ে কার্যকর চিন্তা ভাবনা দরকার। মিরেরসরাই শিল্পাঞ্চল চালু হলে ৫০ হাজার একরে শিল্প হলে সেই শিল্পের বিপুল উৎপাদন বিদেশে কিভাবে পাঠানো যাবে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি সুপারিশ করেন, বে টার্মিনাল যদি বেসরকারি কেউ চালাতে পারে তার ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। প্রত্যেকটা বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের আওতায় করতে হবে এমন কোন কথা নেই। আলাদা আলাদা বন্দর করা দরকার। মুম্বাই তে দু’টি বন্দর। একটা নবসেবা, একটি মুম্বাই। নবসেবা নতুন। নতুন নতুন বন্দর হোক নতুন ম্যানেজমেন্টে। বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করলে অনেক ভাল হবে। নিশ্চয় সবার কমবেশি মনে আছে যে টিএন্ডটি’র জিএম এর কাছে একসময়ে দিনের এগারোটা থেকে একটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হতো টেলিফোন সংযোগ পাওয়ার আবেদন নিয়ে। এখন কেউ খবরও নেয় না। তিনি ধারণা দেন যে বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি করে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যাবে কমপক্ষে দু’শতাংশ।